সংক্রমণ বাড়ছেই, ডেঙ্গু মোকাবিলায় দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

গত বছরের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫৩%, মৃত্যু বেড়েছে ২১%

অনলাইন ডেস্ক
০৬ অক্টোবর ২০২৫, ২২:১৮
শেয়ার :
সংক্রমণ বাড়ছেই, ডেঙ্গু মোকাবিলায় দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৪২ জনের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা ১৯৮। গত বছরের একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছিল ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬৩।

 চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৩ শতাংশ বেশি। আর মৃতের সংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের পরও এই সংখ্যা বাড়তে থাকায় ৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে মোট ৪৮ হাজার ৮৬৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২০৩ জনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাব এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ।

এদিকে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতেও রোগীর চাপ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। চিকিৎসকরা জানান, অনেক রোগী প্রাথমিক লক্ষণ উপেক্ষা করে দেরিতে হাসপাতালে আসেন। এতে চিকিৎসার সময় তাদের শারীরিক অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, প্লাটিলেট দ্রুত কমা এবং পেট ব্যথা - এই ধরনের লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা না গেলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সময়মতো চিকিৎসা এবং প্রাথমিক সতর্কতা গুরুত্বপূর্ণ।

চলতি বছরের এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের ৬০ শতাংশ ঢাকার সরকারি ছয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রাজধানী ছাড়াও দেশের ১০টি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। বরগুনা, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, গাজীপুর, পিরোজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলা পর্যায়ে জটিল রোগী ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় অনেক রোগী রাজধানীতে ভর্তি হচ্ছে।

ইবনে সিনা হাসপাতালের আরএমও ও ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ডা. তামিম আল মিশু বলেন, ‘এবার ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা ভিন্ন ধরনের। অনেক রোগীর প্রাথমিক উপসর্গ দেখে শনাক্ত করা কঠিন। এজন্য আমরা রোগীকে ১০ দিনের জন্য আইসোলেশনে রেখে বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’

তিনি আরও জানান, ঢাকাসহ বড় শহর থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষ ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রামীণ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, ফলে রোগীরা দেরিতে চিকিৎসা পাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু ও অন্যান্য এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ১১টিতেই স্থায়ী কীটতত্ত্ববিদ নেই। ফলে জেলা ও সিটি পর্যায়ে জরিপ এবং লার্ভা ধ্বংস কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনবল সংকট ও বিশৃঙ্খলার কারণে এ সম্পর্কিত সুপারিশগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

গবেষণা বলছে, চলতি বছর সংক্রমণের ৭০ শতাংশই ডেন-২ স্ট্রেইনে হয়েছে। দ্বিতীয়বারের সংক্রমণ (সেকেন্ডারি ডেঙ্গু) মারাত্মক এবং মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বেশি। বয়স্ক ব্যক্তি, সন্তানসম্ভবা নারী ও অন্যান্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা অত্যন্ত জরুরি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে প্রাক-বর্ষা, বর্ষাকালীন ও বর্ষা পরবর্তী পর্যায়ক্রমিক জরিপ অপরিহার্য। কিন্তু জরিপে বিলম্ব এবং সুপারিশ বাস্তবায়নের ঘাটতি দেশকে ক্রমেই স্বাস্থ্য সংকটে ফেলে দিয়েছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে মৃত্যুর হার আরও বাড়তে পারে।

তাদের মতে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, হাসপাতালে রোগীর দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সেই সাথে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।