অবরোধ ভাঙার অহিংস প্রচেষ্টা
গাজা অভিমুখে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, যা গ্লোবাল ফ্রিডম ফ্লোটিলা নামেও পরিচিত, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি গঠিত একটি আন্তর্জাতিক নাগরিক উদ্যোগ। এর লক্ষ্য ইসরায়েলের আরোপিত নৌ-অবরোধ ভেঙে গাজায় খাদ্য, ওষুধ, পানি পরিশোধক এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। ‘সুমুদ’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ ‘অটলতা’ বা ‘অবিচল সহনশীলতা’, যা ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের প্রতীক। এই উদ্যোগে চারটি প্রধান সংগঠন- ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা, মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা এবং সুমুদ নুসান্তারা- একত্রে কাজ করে। ৪৪টির বেশি দেশের প্রায় ৫০০ অংশগ্রহণকারী এবং ৪০টিরও বেশি জাহাজ নিয়ে এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাগরিক-নেতৃত্বাধীন নৌবহর। এই ফ্লোটিলা শুধু মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম নয়, বরং গাজার দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকটের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের একটি রাজনৈতিক প্রতীক। আয়োজকরা এটিকে
শান্তিপূর্ণ ও অহিংস মিশন হিসেবে বর্ণনা করেন, যা অবরোধের অবৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব আঞ্চলিক জলসীমা নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি জানায়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস বিশ্বাস
গাজার অবরোধের ঐতিহাসিক পটভূমি
গাজা উপত্যকা। ভূমধ্যসাগরের তীরে ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট অঞ্চল ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলের কঠোর নৌ-অবরোধের মুখে। হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে এই অবরোধ আরোপিত হয়, যা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টিতে বিতর্কিত। এই অবরোধ গাজার অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজায় ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয় এবং অবরোধের কারণে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় ৮০% ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল এবং ৬,৩০,০০০ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।
অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। ২০০৮ সালে ফ্রি গাজা মুভমেন্ট প্রথমবার জাহাজ পাঠিয়ে সফল হয়। কিন্তু ২০১০ সালের মাভি মারমারা ঘটনায় ইসরায়েলি কমান্ডোরা তুরস্কের একটি জাহাজে হামলা চালিয়ে ১০ জন অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করে, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তোলে। ২০১১, ২০১৫, ২০১৮ এবং ২০২৪-২৫ সালে অন্যান্য ফ্লোটিলা (যেমন- ম্যাডলিন, হান্দালা) ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক বা হামলার শিকার হয়। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ উদাহরণ, যা ২০২৫ সালের জুলাইয়ে হান্দালা আটকের পর গঠিত হয়। এটি শুধু ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম নয়, বরং অবরোধের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনি বিতর্ক উত্থাপনের একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ফ্লোটিলাগুলো গাজার সংকটকে বিশ্ব মিডিয়ায় তুলে ধরে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে সামরিক ও কূটনৈতিক বাধার কারণে সাফল্য সীমিত।
গঠন সংগঠন এবং অংশগ্রহণকারী
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা চারটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে অবরোধ ভাঙার ব্যবহারিক দিকগুলো পরিচালনা করে। গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা তৃণমূল পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী সংহতি গড়ে তুলেছে। মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং সুমুদ নুসান্তারা মালয়েশিয়াসহ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সমর্থন জোরদার করে। এই জোটগুলোর সমন্বয়ে ফ্লোটিলা ২০২৫ সালের জুলাইয়ে গঠিত হয়।
স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ক্লিওনিকি আলেক্সোপৌলো (ইতিহাসবিদ), ইয়াসেমিন আকার (মানবাধিকারকর্মী), থিয়াগো আভিলা (পরিবেশবাদী), মারিয়া এলেনা ডেলিয়া (পদার্থবিদ), সাইফ আবুকেশেক (ফিলিস্তিনি কর্মী), মুহাম্মদ নাদির আল-নুরি (মানবতাবাদী), মারুয়ান বেন গুয়েত্তায়া (রাজনৈতিক কর্মী), ওয়ায়েল নাওয়ার (ন্যায়বিচারক), হায়ফা মানসুরি (সমাজ গবেষক) এবং তোরকিয়া চাইবি (কৃষক নেত্রী)। এই কমিটি অভিযানের পরিকল্পনা, সমন্বয় ও প্রচারে নেতৃত্ব দেয়।
ফ্লোটিলায় ৫০০-এর বেশি অংশগ্রহণকারী ছিলেন, যাদের মধ্যে আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী এবং ধর্মীয় নেতারা রয়েছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন গ্রেটা থুনবার্গ, ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলা, এমা ফুরো, রজার ওয়াটার্স, সুসান সারান্ডন ও মার্ক রাফালো। জাহাজগুলোতে প্রায় ৪৫ টন ত্রাণসামগ্রী ছিল, যার মধ্যে খাদ্য, ওষুধ ও পানি পরিশোধক যন্ত্র অন্তর্ভুক্ত। মালয়েশিয়ার জাহাজগুলো ‘ওয়াটারমেলন ফ্লোটিলা’ নামে পরিচিত, যা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক তরমুজকে তুলে ধরে। এই বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ ফ্লোটিলাকে একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে, যা উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন অতিক্রম করে সংহতি গড়ে তুলেছে।
যাত্রা ঘটনাক্রম এবং সাম্প্রতিক অবস্থা
ফ্লোটিলার যাত্রা ২০২৫ সালের আগস্টের শেষে শুরু হয়। ৩০ আগস্ট জেনোয়া, ৩১ আগস্ট বার্সেলোনা এবং ৭ সেপ্টেম্বর তিউনিস ও কাতানিয়া থেকে কনভয় রওনা দেয়। পথে তিউনিসিয়া, সিসিলি ও গ্রিসের সিরোস থেকে আরও জাহাজ যুক্ত হয়। ঝড় এবং যান্ত্রিক সমস্যার কারণে যাত্রা বিলম্বিত হয়। স্প্যানিশ কনভয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে তিউনিসে পৌঁছায়।
পথে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। ৯ সেপ্টেম্বর তিউনিসে একটি জাহাজে আগুন ধরে, যা ড্রোন হামলা বলে সন্দেহ করা হয়। পরের রাতে আরেকটি জাহাজে একই ধরনের ঘটনা। ২৪ সেপ্টেম্বর ক্রিটের কাছে ১১টি জাহাজে ড্রোন হামলা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ক্রিট থেকে গাজার দিকে অগ্রসর হলে ইসরায়েলি নৌবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। অক্টোবরের ১-৩ তারিখের মধ্যে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ৪২টি জাহাজ আটক হয়, যার মধ্যে ৪৭০-এর বেশি অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন, যাদের মধ্যে গ্রেটা থুনবার্গও ছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে জ্যামার ব্যবহার করে।
সাম্প্রতিক আপডেটে, আটককৃতরা কেটজিওট কারাগারে রয়েছেন, যেখানে অনশন ও তৃষ্ণা ধর্মঘট (থার্স্ট স্ট্রাইক) চলছে। থিয়াগো আভিলা ওষুধ কনফিসকেট হওয়ায় থার্স্ট স্ট্রাইক শুরু করেন। ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট সারাহ উইলকিনসন ইসরায়েলি বাহিনীর সমালোচনা করেন। কিছু অ্যাক্টিভিস্ট ডিপোর্ট হলেও ফরাসি অংশগ্রহণকারীরা এখনও আটক। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশ মুক্তির জন্য আলোচনা করছে। এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় হওয়ায় জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত, যা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের সম্ভাবনা বাড়ায়।
বাংলাদেশের পক্ষে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার উদ্দেশে কনসায়েন্স নামে জাহাজে যাত্রা করা নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’-তে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহিদুল আলম। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এমন অভিযাত্রায় অংশ নিলেন।
‘বাংলাদেশের সব মানুষের ভালোবাসা নিয়ে অংশ নিচ্ছি’ উল্লেখ করে শহিদুল আলম বলেন, ‘এই সংগ্রামে যদি আমরা পরাজিত হই, তাহলে মানবজাতি পরাজিত হবে।’
মানবিক, রাজনৈতিক এবং আইনি দিক
মানবিক দিক
ফ্লোটিলা গাজার দুর্ভিক্ষ ও মানবিক সংকটকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গাজার ৮০% বাসিন্দা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল এবং অবরোধের কারণে স্থলপথে সহায়তা পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। ফ্লোটিলার ৪৫ টন ত্রাণ প্রতীকী হলেও এটি বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আটককৃত অ্যাক্টিভিস্টদের নির্যাতন (যেমন- মাথায় আঘাত, ঘুম থেকে বঞ্চিত করা) মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইসরায়েলের অবরোধ একটি সম্মিলিত শাস্তি, যা গণহত্যার অভিযোগকে শক্তিশালী করে।
রাজনৈতিক দিক
ফ্লোটিলা ইসরায়েলের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। গ্রেটা থুনবার্গের অংশগ্রহণ জলবায়ু ও ফিলিস্তিনি আন্দোলনের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, আলজেরিয়ার মতো গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর অংশগ্রহণ ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীরবতা তাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। এই বিভাজন গ্লোবাল নর্থ ও সাউথের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য তুলে ধরে।
আইনি দিক
আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজ আটক জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সনদ (UNCLOS) এবং জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে। ফ্লোটিলার আয়োজকরা দাবি করেন- অবরোধ অবৈধ, কারণ এটি বেসামরিক জনগণের ওপর শাস্তি আরোপ করে। ইসরায়েল দাবি করে, অবরোধ অস্ত্রপাচার রোধের জন্য, তবে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের পামার রিপোর্ট অবরোধকে আইনি বললেও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করে। ফ্লোটিলার আটক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) মামলার পথ খুলতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে ‘অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করে। বিশ্লেষণে, ফ্লোটিলা নাগরিক অ্যাকটিভিজমের শক্তি দেখায়, তবে সামরিক শক্তির সামনে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ফ্লোটিলার রাজনৈতিক প্রভাব
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা গাজার সংকটকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন করে তুলে ধরেছে। এটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর, যেমন- মালয়েশিয়া, তুরস্ক, কলম্বিয়ার মধ্যে সংহতি শক্তিশালী করেছে। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান হামলাকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ বলেন। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া মিশ্র। ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন তাদের নাগরিকদের মুক্তির জন্য আলোচনা করছে, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফ্লোটিলাকে সমর্থন করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো মন্তব্য করেনি, যা তাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গ্রেটা থুনবার্গের অংশগ্রহণ ফ্লোটিলাকে মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। তিনি জলবায়ু আন্দোলনের সঙ্গে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের সংযোগ স্থাপন করেন, যা পরিবেশবাদী এবং মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যে নতুন জোট গড়ে। তবে তার পদত্যাগ এবং আটক হওয়া বিতর্ক সৃষ্টি করে। সামাজিক মাধ্যমে তাকে সমালোচনা ও সমর্থন দুই-ই মেলে। বিশ্লেষণে, ফ্লোটিলা বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের একটি সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে।
মানবিক প্রভাব এবং দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য
ফ্লোটিলা গাজার মানবিক সংকটের তীব্রতা তুলে ধরে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গাজার ২৩ লাখ মানুষের ৮০% ত্রাণনির্ভর। ফ্লোটিলার ৪৫ টন ত্রাণ প্রতীকী হলেও এটি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মালয়েশিয়ার ‘ওয়াটারমেলন ফ্লোটিলা’ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক তরমুজকে তুলে ধরে, যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। দীর্ঘ মেয়াদে, ফ্লোটিলা নাগরিক অ্যাকটিভিজমের একটি নতুন মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি দেখায় যে পরিবেশবাদী, মানবাধিকারকর্মী এবং ধর্মীয় নেতারা একত্রে কাজ করতে পারেন। তবে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি এবং পশ্চিমা সমর্থন এর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় নৌবহর বা কূটনৈতিক চাপের পথ খুলতে পারে।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব
ফ্লোটিলা একটি সাংস্কৃতিক ঘটনাও। ‘ওয়াটারমেলন ফ্লোটিলা’ এবং ফিলিস্তিনি পতাকার ব্যবহার সংহতির প্রতীক হিসেবে কাজ করে। সামাজিক মাধ্যমে #GlobalSumud এবং #BreakTheSiege হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করে, যা তরুণদের মধ্যে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। শিল্পী ও সংগীতজ্ঞরা, যেমন- রজার ওয়াটার্স, গান ও শিল্পকর্ম তৈরি করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন। বিশ্লেষণে, ফ্লোটিলা ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে গ্লোবাল কালচারাল মুভমেন্টে রূপান্তরিত করে, তবে পশ্চিমা মিডিয়ার সমালোচনা সাংস্কৃতিক বর্ণনার লড়াই তুলে ধরে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং ঐতিহাসিক তুলনা
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা গাজার অবরোধের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে, এটি আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখায়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এর সাফল্য সীমিত করে। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মতো, ফ্লোটিলা অহিংস প্রতিরোধের মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় নাগরিক উদ্যোগের পথ প্রশস্ত করতে পারে, তবে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি এবং পশ্চিমা সমর্থন এর সামনে প্রধান বাধা।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপট
ফ্লোটিলার আইনি ভিত্তি ছিল জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সনদ (টঘঈখঙঝ) এবং জেনেভা কনভেনশন। আয়োজকরা দাবি করেন, গাজার অবরোধ অবৈধ, কারণ এটি বেসামরিক জনগণের ওপর সম্মিলিত শাস্তি আরোপ করে। ইউএনক্লস অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজের স্বাধীন চলাচলের অধিকার রয়েছে। ইসরায়েল দাবি করে, অবরোধ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য, তবে এর কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। ২০১০ সালের পামার রিপোর্ট অবরোধকে আইনি বললেও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করে। ফ্লোটিলার আটক এবং নির্যাতন জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে ‘অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) নতুন মামলার পথ খুলতে পারে, যদিও ইসরায়েল আইসিজের সদস্য নয়। বিশ্লেষণে, ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ইসরায়েলের পক্ষে থাকায় আইনি প্রক্রিয়া জটিল।
সংকটের সমাধান
গাজার সংকট সমাধানে ফ্লোটিলার মতো উদ্যোগ কতটা কার্যকর, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সম্ভাব্য সমাধানগুলো হলো :
কূটনৈতিক চাপ : ফ্লোটিলার ঘটনা ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। কলম্বিয়া ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর পদক্ষেপ এটিকে শক্তিশালী করে। ভবিষ্যতে আরও দেশ যদি এই পথে যায়, অবরোধ শিথিল হতে পারে।
আইনি পদক্ষেপ : আন্তর্জাতিক জলসীমায় হামলা ইউএনক্লস লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি কর্মীরা আইসিজে-তে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা অবরোধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
নাগরিক আন্দোলন : ফ্লোটিলা নাগরিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। গ্রেটা থুনবার্গের অংশগ্রহণ তরুণদের আকর্ষণ করে। সামাজিক মাধ্যমে #BreakTheSiege হ্যাশট্যাগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
তবে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি এবং পশ্চিমা সমর্থন এই প্রচেষ্টাগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। ফ্লোটিলা স্থায়ী সমাধান না হলেও এটি আরও বৃহৎ কূটনৈতিক ও আইনি প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
ফ্লোটিলার ওপর হামলা বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় তোলে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, গ্রিস, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, কলম্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়। ইতালিতে বড় ধরনের ধর্মঘট হয়। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো ইসরায়েলি কূটনৈতিক প্রতিনিধিকে বহিষ্কার করেন এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামলাকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহিত করেন। ফ্রান্স ও ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আটককৃতদের মুক্তির জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করছেন। স্পেন ও ইতালি সহায়তার জন্য নৌবাহিনী মোতায়েন করে, তবে গাজার কাছাকাছি পৌঁছলে তারা পিছু হটে। তুরস্ক ফ্লোটিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিপরীতে, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির অংশগ্রহণকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে কারারুদ্ধ করার দাবি জানান। ইউরোপীয় কমিশন ফ্লোটিলাকে সমর্থন করে না। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রানচেসকা আলবানেসে ফ্লোটিলার পক্ষে সমর্থন জানান। সামাজিক মাধ্যমে অ্যাক্টিভিস্টরা, যেমন- ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ট্যাগ করে, মুক্তির দাবি জানান।
এই প্রতিক্রিয়া গ্লোবাল সাউথ (কলম্বিয়া, তুরস্ক) এবং গ্লোবাল নর্থ (ইউরোপ)-এর মধ্যে বিভাজন দেখায়। পশ্চিমা দেশগুলোর নীরবতা তাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এবং মানবাধিকার নিয়ে দ্বৈত মানদণ্ড প্রকাশ করে।
ফ্লোটিলার প্রস্তুতি এবং চ্যালেঞ্জ
বছরের শুরু থেকে সংগঠনগুলো তহবিল সংগ্রহ, জাহাজ সংগ্রহ, ত্রাণ সংগ্রহ এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ শুরু করে। ত্রাণের মধ্যে ছিল চাল, গম, অ্যান্টিবায়োটিক, পেইনকিলার, সার্জিক্যাল কিট, পানির ফিল্টার এবং শিশুদের পুষ্টিকর খাবার। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, স্পেন ও ইতালির স্থানীয় সংগঠনগুলো ত্রাণ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণে মানবাধিকার আইন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন এবং অহিংস প্রতিরোধের কৌশল শেখানো হয় এবং তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেয়। তবে চ্যালেঞ্জও ছিল। ভারত ও মিশর, তাদের নাগরিকদের অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাহাজগুলোর যান্ত্রিক সমস্যা এবং ঝড়ের কারণে যাত্রা বিলম্বিত হয়। তথ্য ফাঁসের আশঙ্কা গোপনীয়তা বজায় রাখা কঠিন করে। সামাজিক মাধ্যমে ফ্লোটিলার পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে, যা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে আসে। বিশ্লেষণে, ফ্লোটিলার সাফল্য নির্ভর করছিল সমন্বয়, গোপনীয়তা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর, তবে ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং পশ্চিমা দেশগুলোর নীরবতা এটিকে জটিল করে তুলেছিল।
সামাজিক মাধ্যম
সামাজিক মাধ্যম ফ্লোটিলার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। #GlobalSumud এবং #BreakTheSiege হ্যাশট্যাগ বিশ্বব্যাপী ট্রেন্ড করে। ফরাসি অ্যাক্টিভিস্টরা তাদের আটকের সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে ট্যাগ করে মুক্তির দাবি জানান। তবে কিছু ইসরায়েলপন্থি অ্যাকাউন্ট ফ্লোটিলাকে হামাসের সঙ্গে যুক্ত বলে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
সমালোচনা
ইসরায়েল ফ্লোটিলাকে ‘প্ররোচনামূলক’ ও ‘সন্ত্রাসী’ বলে সমালোচনা করে। পশ্চিমা মিডিয়ার কিছু অংশ এটিকে গাজার পরিস্থিতি জটিল করার জন্য দায়ী করে। কিছু মানবাধিকার সংগঠন মনে করে, ফ্লোটিলার ত্রাণ সংকটের তুলনায় অপর্যাপ্ত। তবে সমর্থকরা এটিকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন। ফ্রানচেসকা আলবানেসে বলেন, ‘ফ্লোটিলা গাজার জনগণের প্রতি বিশ্বের সংহতির প্রতীক।’ এটি সংকটকে আলোচনায় নিয়ে আসে, অন্যথায় যা উপেক্ষিত হতো।
শেষ কথা
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা গাজা অবরোধের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধের একটি প্রতীক। এটি মানবিক, রাজনৈতিক, আইনি ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলে। যদিও ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ এর তাৎক্ষণিক সাফল্য বাধাগ্রস্ত করে, তবু এটি গাজার সংকটের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফ্লোটিলার দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং নাগরিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ওপর। এটি ‘সুমুদ’- অটলতা ও প্রতিরোধের চেতনাকে- বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে, যা গাজার মুক্তির জন্য ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।