আকাশপথের প্রবেশদ্বার নাকি হয়রানির হাট

গোলাম সাত্তার রনি
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আকাশপথের প্রবেশদ্বার নাকি হয়রানির হাট

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের আকাশপথের প্রধান প্রবেশদ্বার। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই পথে আসা-যাওয়া করেন। কেউ ফিরছেন পরিবারের কাছে দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে, কেউ যাচ্ছেন দূর দেশে নতুন জীবনের সন্ধানে। অথচ সেই প্রত্যাশার সন্ধান বা ফেরা কখনোই সুখকর হয় না। বরং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটি হয়ে উঠেছে যাত্রীদের জন্য দুঃস্বপ্নের এক গন্তব্য।

সকাল হোক কিংবা গভীর রাত, শাহজালাল বিমানবন্দরে ঢুকলেই চোখে পড়ে এক অস্বস্তিকর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। কারও চোখে জাপটে ধরে আছে ভ্রমণক্লান্তি, কারও মুখে উদ্বেগ, অনেকে এক হাতে শিশুকে কোলে নিয়ে, আরেক হাতে স্যুটকেস টেনে দাঁড়িয়ে আছেন গেটের সামনে। ঘোষণাগুলো আসে ভাঙাচোরা শব্দে- যেখানে কোন ফ্লাইট কখন, কোন গেট পরিবর্তন হলো- তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। বন্দর টার্মিনালে নিষ্প্রভ আলো, দেয়ালগুলো বিবর্ণ, ফ্লোরে মাঝেমধ্যে পানি জমে আছে। যেন কারওয়ানবাজারের সবজিবাজার। পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর।

যাত্রীরা বলেন, এখানে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। লাগেজ এলোমেলো, কোথাও ঘোষণাবিহীনভাবে বেল্ট পরিবর্তন হয়, আবার কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ব্যাগ মেলে না। মালয়েশিয়াফেরত শ্রমিক খলিলুর রহমান বলেন, ‘দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি লাগেজ বেল্টের সামনে, অথচ আমার স্যুটকেস আসছে না। একেকজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলে একেক রকম উত্তর দেন। মনে হচ্ছে আমি যেন নিজের জিনিস খুঁজে অপরাধ করেছি।’

লাগেজ হাতে পাওয়ার আগেই যাত্রীদের ঘিরে ধরছে দালালচক্র। তাদের দাবি, ব্যাগ বের করতে চাইলে দিতে হবে বকশিশ। আর যদি কেউ এড়িয়ে যেতে চান, তাহলে শুনতে হয় কথা, কিংবা বিলম্ব করা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে। প্রবাসফেরত এক নারী যাত্রী বলেন, ‘ব্যাগ পাওয়ার আগে একজন এসে বলল, টাকা না দিলে অনেক দেরি হবে। আমি ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে দিয়ে দিলাম। ওরা জানে কোথায় চাপ দিতে হয়।’

এখানকার সবচেয়ে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হলো অফিসারদের মানসিক আচরণ। ভিনদেশে যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স আনেন, দেশের অর্থনীতিকে দিয়েছেন মেরুদণ্ড, যাঁরা ওই সব দেশে সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে কাটিয়ে আসেন, তাঁরা নিজ দেশে ফিরে হন অপমানিত। কাতারগামী যাত্রী সাইফুল আলম বলেন, ‘আমার ব্যাগে কিছু শাকসবজি ছিল, একটু ওজন বেড়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে যে ভাষায় কথা বলল, তা শুনে আমি স্তব্ধ। একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন ব্যবহার কল্পনাও করিনি।’

দুবাইগামী যাত্রী মোহাম্মদ রাশেদ জানান, তাঁর ব্যাগের ওজন নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছিল মাত্র ২ কেজি। নিয়ম অনুযায়ী চার্জ দেওয়ার পরও তাঁকে আলাদা করে অর্থ দিতে হয়েছে, তা না হলে ব্যাগ পেতেই সময় লাগত। যাত্রীদের অভিমত, অতিরিক্ত অর্থ আদায় এখন যেন এখানে এক অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

শুধু ভেতরে নয়, বাইরেও দেখা যায় একই চিত্র। বিমানবন্দরের বাইরের পার্কিং এরিয়া ভিজিটর টয়লেট ব্যবহারের মতো মৌলিক অধিকারও এখানে নিরাপদ নয়। শ্যালককে বিদায় জানাতে এসে এক বেসরকারি চাকরিজীবী শাহেদ ইসলাম বললেন, ‘টয়লেটের দরজায় কয়েকজন দাঁড়িয়ে টাকা চাইছে। একবার নয়, বারবার এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এটা কি স্বাভাবিক?’ তিনি মনে করেন, এমন পরিস্থিতি দেশের সম্মানকেই আঘাত করে।

বিমানবন্দরের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে ভেতরের করিডোর পর্যন্ত যত্রতত্র গাড়ির দালাল ও ফোটার চক্রের ঘোরাঘুরি, এই সমস্যাও নতুন নয়। কখনও তারা লাগেজ তোলার দায়িত্ব নেয়, কখনও যাত্রীর হয়ে ভেতরে ঢোকার টিকিট ‘দেখিয়ে’ দেয়। অভিযোগ রয়েছে, এই দালালদের পেছনে রয়েছে ভেতরের কিছু অসাধু স্টাফ। যাত্রীদের মতে, এটা শুধু অবহেলা নয়, বরং একটি সংগঠিত দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি।

এক বৃদ্ধ প্রবাসীযাত্রী হুইলচেয়ারে বসে গেট খুঁজছিলেন, ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন- ‘বিদেশে গেলে আমরা প্রবাসী হয়ে সম্মান পাই, দেশে ফিরলে মানুষ হয়ে অপমান পাই। দেশের মুখটা এভাবে দেখব ভাবিনি।’

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বিভিন্ন সময় যাত্রীসেবার উন্নয়নের আশ্বাস দিলেও বাস্তবচিত্রে তার প্রতিফলন নেই। ঘন ঘন বিবৃতি এলেও মাঠপর্যায়ে নেই কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা। এদিকে প্রবাসীরা মনে করেন, তাঁরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, অথচ তাঁদের সম্মান দেওয়ার মতো কোনো পরিকাঠামো নেই এই ‘প্রবেশদ্বারে’।

এ ছাড়া রয়েছে কাস্টমসের হয়রানি। দীর্ঘদিন প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স আহরণ করে দেশে ফেরার পর লাগেজ খুলে তছনছ করার অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। রাজস্ব আইন অনুযায়ী, মাত্র ৫ শতাংশ লাগেজ তল্লাশি করার বিধান রয়েছে। এ নিয়ম মানেন না কর্মরত কর্মকর্তারা। এর ফলে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিদেশফেরত যাত্রীরা।

সবচেয়ে বেশি দুর্বৃত্তপণার শিকার হন বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর। গোলচত্বরে এলে হিজড়া নাম ২০-২৫ জনের একটি চক্র বিদেশফেরত যাত্রীদের মাইক্রোবাস ঘিরে ধরেন। দাবি করেন মোটা অঙ্কের অর্থ। না দিলে হতে হয় অপদস্থ। পুলিশের নাকের ডগায় এ কর্মকাণ্ড চললেও তারা থাকেন নিশ্চুপ।

শাহজালাল বিমানবন্দরে শুল্ক আদায়ের নামে হয়রানির অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ৫ শতাংশ যাত্রীর লাগেজ তল্লাশি করা হয়। এর বাইরে কোনো যাত্রীর গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তাঁর লাগেজ তল্লাশি করার নিয়ম। বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনা ও যাত্রী হয়রানির বিষয়ে জানতে গতকাল শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগিব সামাদের সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।

বিমানবন্দরের গোলচত্বরে অবস্থিত পুলিশ বক্সের পাশেই দিন-রাত প্রবাসীদের গাড়ি আটকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা ধরনের হয়রানির বিষয়ে বিমানবন্দর পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই গফুর বলেন, হিজড়াদের উৎপাতের বিষয়টি আমি অবগত; তবে এই বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব থানা পুলিশের। তবে মাঝেমধ্যে আমরাও অভিযান পরিচালনা করি। পুলিশ বক্স থানার আওতাধীন জানাতেই তিনি বলেন, আমি বক্সের দায়িত্বে, হিজড়াদের নিবৃত্ত করার দায়িত্ব আমার নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। লাগেজ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি, দালাল নির্মূলের জন্য কড়া নজরদারি এবং স্টাফদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো পরিবর্তন আসবে না। প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব- এমন মত অনেকের। তাঁরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হলে দেশের প্রথম ইমপ্রেশন এই বিমানবন্দরকে হতে হবে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও সম্মানজনক। অন্যথায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কেবল এক টুকরো ভবন থাকবে; দেশের মুখ হয়ে উঠবে না। বরং তা হয়ে উঠবে একটি লজ্জাজনক প্রতীক, যা বিদেশফেরত নাগরিককে প্রথম ধাক্কাটা দেয়- নিজ দেশেই।