নারীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার

অনলাইন ডেস্ক
০৪ অক্টোবর ২০২৫, ২১:০১
শেয়ার :
নারীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার

বাংলাদেশে কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা এক নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সকল ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করাসহ কন্যাশিশুদের কল্যাণে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরেছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম।

আজ শনিবার জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের আয়োজনে এবং এডুকো বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়। জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার, ডিবেড ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেমের পরিচালক নিশাত সুলতানা, অ্যাডভোকেট ফাহমিদা রিংকী প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক ও অপরাজেয় বাংলাদেমের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর আহসানা জামান এ্যানী।

অনুষ্ঠানে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারী ও কন্যাশিশুদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু এখনও তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমি মনে করি, বাল্যকাল থেকেই নারীদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার। বাল্যকাল থেকেই তাদের জন্য সুযোগ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার, তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করা দরকার। কারণ নারীরা পুষ্টিবান হলে পুরো জাতি পুষ্টিবান হবে, তারা শিক্ষিত হলে পুরো জাতি শিক্ষিত হবে। নারীর অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন হলে পুরো জাতির অবস্থা পরিবর্তিত হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনায় পাঁচবার উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়নি। এই ঘটনায় মূলত নারী রাজনৈতিক অধিকার পরাজিত হয়েছে। কেউ জয়ী হয়নি। পুরুষতন্ত্র জয়ী হয়েছে।’

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য, অপতথ্য আমাদের সব উইপোকার মতো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাল্যবিয়ের মতো একটি সংবেদনশীল সামাজিক বিষয় নিয়েও মিথ্যা তথ্য প্রদান করা হতো। বাল্যবিয়ের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে ফেলেছে তারা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ তে ছেলেদের ২১ বছরের পূর্বে ও মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ না হলে তাকে বাল্যবিবাহ বলা হয়েছে। কিন্তু একই আইনের ধারা-১৯ এ কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছরের কম ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হলে তা বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য হবে না। উক্ত ১৯ ধারায় নিদিষ্ট কোনো বয়সের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমাদের দীর্ঘ দিনের অর্জন টেকসই হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘কন্যাশিশুদের আত্মমর্যাদা, দক্ষতা, সাহসিকতা ও নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো কন্যাশিশুর বিকাশ ও সুরক্ষায় পুরোপুরি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারিনি। আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের কাছে কন্যাশিশুর সুরক্ষায় একটি সংবেদনশীল সমাজ ব্যবস্থা আমরা প্রত্যাশা করি।’

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আহসানা জামান এ্যানী বলেন, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এডুকো বাংলাদেশের সহযোগিতায় দৈনিক পত্রিকা থেকে কন্যাশিশুদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা, নিপীড়ন ও নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ এবং খুন ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের তেরোটি (১৩) ক্যাটাগরির আওতায় ৫৬টি সাব ক্যাটাগরিতে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) মোট ৫৪ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার, যা গতবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি হলেও ২০২৩ সালের তুলনায় কম।

তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব থেকে নিকৃষ্টতম রূপ হলো ধর্ষণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তারপরও ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। জানুয়ারি-আগস্ট ২০২৫ অর্থাৎ গত ৮ মাসে ৩৯০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তন্মধ্যে ৪৩ জন গণধর্ষণ এবং ২৯ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ/গণধর্ষণের পর ১৫ জন কন্যাশিশু খুন হয়েছে ও ৫ জন আত্মহত্যা করেছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধের শিকার হতে হচ্ছে চার মাস থেকে এক বছর বয়সের শিশুদেরকেও। এর অন্যতম প্রধান কারণ আইন বাস্তবায়নে শিথিলতা। আমরা লক্ষ করেছি, বেশকিছু ধর্ষণের ঘটনা নিকটাত্মীয় ও পরিচিতদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুরা সারাজীবন একটা ট্রমার মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে অপারগ হয়; যার কুফল পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও পড়ে। তবে মনে রাখতে হবে, এ ধরনের সহিংসতার বিপরিতে খুব কম সংখ্যক ভুক্তিভোগীই সমাজের ভয়ে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে না।

আহসানা জামান এ্যানী বলেন, জানুয়ারি-আগস্ট ২০২৫ সময়কালে অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ৩৪ জন কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণের শিকার ১৮ জন কন্যাশিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। একই সময়কালে ১০৪ জন কন্যাশিশু আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, ৮৩ জন কন্যাশিশু খুন হয়েছে, ৫০ জন কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে, ২০৫ জন কন্যাশিশু পানিতে ডুবে মারা যান, ১৯ জন কন্যাশিশু নিজগৃহে ও স্বামীগৃহে পারিবারিক সহিংসতার শিকার। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে সাইবার বুলিং মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। ফেক বা বট আইডি’র মাধ্যমে কন্যাশিশুসহ নারী শিক্ষার্থী, নারী রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন পেশার নারীদের বুলিং করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, পরিবারে কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি বিনিয়োগ কম হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কন্যাশিশুর চাইতে ছেলেশিশুর চাহিদা গুরুত্ব পায়। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে ছেলেশিশু ‘দেখভাল’ করবে। ছেলের জন্য ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে, কন্যাশিশু বিয়ে হয়ে অন্য পরিবারে চলে যাবে, কন্যাশিশুর জন্য ব্যয়কে খরচ বা অপব্যয় হিসেবে দেখা হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিশু বয়স থেকেই কন্যাশিশুরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারে এ সমস্যা প্রকট। সেসব পরিবারে কন্যাশিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হারও বেশি। কন্যাশিশুরা বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। স্কুল থেকে ফিরে ছেলে শিশু খেলাধুলা করার সুযোগ পেলেও কন্যাশিশুকে গৃহস্থালি কাজ করতে হয়। এটা কন্যাশিশুর জন্য এক ধরনের প্রশিক্ষণও, কারণ বড় হয়ে অন্যের পরিবারে সে যেন গৃহস্থালি কাজ করতে পারে। যেন স্বামীগৃহে ‘বাবা-মা কিছুই শেখায়নি’—এমন অপবাদ সইতে না হয়। যেসব দরিদ্র পরিবারে মাকে বাইরে কাজ করতে হয় সেসব পরিবারে বাধ্যতামূলকভাবে কন্যাশিশুদের গৃহস্থালি কাজ সামলাতে হয়। আর যে পরিবারে কন্যাশিশু থাকে না, সে পরিবারের যাবতীয় গৃহস্থালি কাজ নারীকেই করতে হয়। সমাজে গৃহস্থালি কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। গৃহস্থালি কাজে নারীদের ভূমিকা মুখ্য হলেও এসব কাজ পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যায়ন হয় না।

আহসানা জামান এ্যানী বলেন, কন্যাশিশুদের ছেলেশিশুর মতোই দৃপ্ত, দৃঢ় ও সাহসি করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে কন্যাশিশুরা অশুভ শক্তির প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগোতে পারে। সেজন্য কন্যাশিশু তথা নারীর অগ্রগতি মানেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও উন্নতি। মনে রাখতে হবে, জনশুমারি ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে অর্ধেকের বেশি কন্যাশিশু ও নারী। তারা যদি দেশের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে এটি জুলাই পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গঠনের নিয়ামক হয়ে ওঠতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপারিশগুলো হলো: ১. যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণ ও নিপীড়ন রোধে সর্বস্তরের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুমোদন করা; ২. শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সকল ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা; ৩. ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ আসলে ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যার পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সে এ ঘটনা ঘটায়নি, এ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করা; ৪. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠনের কঠোর নির্দেশনা মনিটরিংয়ের ভিত্তিতে নিশ্চিত করা, যাতে যৌন নিপীড়নের যেকোনো ঘটনার বিচার করা যায়। এ সংক্রান্ত জোরালো নির্দেশনা প্রতিটি অফিস-আদালতেও প্রণয়ন করা, যাতে একজন নারী বা কন্যাশিশু কোনোভাবেই যেন তার সহকর্মী, শিক্ষক বা বন্ধু কারও দ্বারা নিপীড়নের শিকার না হন; ৫. কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করা; ৬. শিশু সুরক্ষায় শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন করা; ৭. বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা; ৮. বর্তমানে বেশিরভাগ শিশুই স্মার্টফোনের মতো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে। তাই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য উচ্চ পর্যায়ের আইসিটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় সব ধরনের পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধ করা; ৯. সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়ন করা, ফেক বা বট আইডি নিষিদ্ধ ও বন্ধ করা, সাইবার বুলিংয়ের এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, একজন কন্যাশিশুও যাতে পর্নোগ্রাফির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা; ১০. সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাজেট বৃদ্ধি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের এর আওতায় আনা; ১১. ক্রমবর্ধমান কন্যাশিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, পরিবার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং পাশাপাশি তরুণ ও যুবসমাজকে সচেতনকরণ সাপেক্ষে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদেরকে যুক্ত করা।’