লোকসান ঠেকাতে আয়ের বিকল্প উৎস খুঁজছে রেল
লোকসান ঠেকাতে আয়ের বিকল্প উৎস খুঁজছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্তমানে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের নেওয়া ঋণের অর্থ সরকারকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। শুধু যাত্রী পরিবহনে রেলকে লাভজনক করা সম্ভব নয়Ñ এমন চিন্তা থেকেই আয়ের বিকল্প উৎস সন্ধান করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলের জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার আয়বর্ধনে ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেহাত জমির বিবরণ ও জমির মাধ্যমে আয় বাড়াতে কী করা যায়- তা নিয়ে চলছে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্য পরিবহন খাতে আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমদানিকৃত লাগেজ ভ্যানের সর্বোত্তম ব্যবহার করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনে লাগেজভ্যান সংযোজন করা হয়েছে। এ সেবা আরও দ্রুত ও প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেলওয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (বেসরকারি) পার্সেল, গুডস ইত্যাদি পরিবহন নীতিমালা-২০২৫ চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যেসব লাগেজ ভ্যান অকেজো অবস্থায় আছে সেসব ওয়াগনের প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ সম্পন্ন করে রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে পার্সেল বেজড ট্রেন চালানোর মাধ্যমে রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলমান বলে জানান রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন।
তিনি আমাদের সময়কে বলেন, রেলওয়ের মালিকানাধীন ভূমির বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী রেলভূমি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আয় বর্ধন করা যেতে পারে। ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেহাত হওয়া জমি এবং নিষ্কণ্টক জমি ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০২০’ অনুযায়ী ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এবং স্টেশন প্লাটফর্মভিত্তিক রেলভূমি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে বাণিজ্যিক বিভাগ হতে বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
রেল কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ের অব্যবহৃত রেলভূমিতে পিপিপি পদ্ধতিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রকল্প যেমনÑ বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, হোটেল, রিসোর্ট, মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ ও অপারেশনের মাধ্যমে নন-কোর বিজনেস স্কিমের আওতায় আয় বর্ধনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পিপিপি পদ্ধতিতে ১২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, রেলওয়েতে অপারেশনাল কাজে ব্যবহৃত হয় ৩১২৬৯ একর জমি। ইজারা দেওয়া আছে ১৪৬৪৬ একর। অব্যবহৃত রয়েছে ৮৮১৬ একর। আর অবৈধ দখলে রয়েছে ৬৭৫৪ একর জমি। এসব জমি কাজে লাগাতে ও দখলমুক্ত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে চায় কর্তৃপক্ষ।
রেলের বড় বদনাম যাত্রীসেবায় ঘাটতি। সময়মতো ট্রেন চলাচল করতে পারছে না। আবার চলতি পথে বিকল হওয়ার জেরে দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরেন যাত্রীরা। এ জন্য যমুনা রেল সেতুর কাজ সম্পন্ন করে ব্রিজের ওপর ডাবল লাইন চালু করা হয়েছে। এতে ব্রিজের ওপর ট্রেনের গতি ২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা থেকে বৃদ্ধি করে ৯৫ কিমি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে যমুনা রেল সেতুর ওপর ট্রেনের রানিং টাইম ২২ মিনিট সাশ্রয় হচ্ছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ২য় ফেজ ভাঙ্গা-যশোর সেকশনে ৮৬ কিমি রেলপথ উদ্বোধন এবং গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর খুলনা-ঢাকার জাহানাবাদ এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-বেনাপোলের মধ্যে রূপসী বাংলা ট্রেন উদ্বোধন করা হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নতুন কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-নরসিংদী এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। এ ছাড়া খুলনা-ঢাকার মধ্যে পদ্মা সেতু হয়ে নবনির্মিত রেলপথে জাহানাবাদ এবং ঢাকা-বেনাপোলের মধ্যে রূপসী বাংলা ট্রেন চালু করা হয়েছে। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে। ফলে এই অংশে শিগগির ডাবল লাইন নির্মাণ কাজ আরম্ভ হবে।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী সেকশনে মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরের জন্য এডিবির সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র অনুমোদিত হলে কাজটি শুরু হবে। কোরিয়ান ইডিসিএফের অর্থায়নে কালুরঘাট এলাকায় বিদ্যমান পুরাতন রেল ব্রিজের উজানে একটি রেল কাম রোড ব্রিজ নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
আরেকটি বড় সমস্যা টিকিটের কালোবাজারি রোধ। এ জন্য অনলাইনে টিকিট কালোবাজারি রোধে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। টিকিট ক্রয়ের আগে যাত্রী রেজিস্টার্ড মোবাইল নম্বরে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অপারেটিং রেশিও ছিল ২.৫, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অপারেটিং রেশিও ছিল ২.০৯। এতে তুলনামূলক ব্যয় কমেছে। অর্থাৎ ব্যয় ও আয়ের পার্থক্য কমে এসেছে।
সরকারি গণপরিবহন ট্রেনে চাহিদার তুলনায় আসন কম। তাই যাত্রীরা টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ করেন। কারণ রেলে লোকোমোটিভ ও কোচ সংকট বহুদিনের। বিদ্যমান ইঞ্জিন-বগির বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। অপ্রতুল মেরামতের ব্যবস্থা। কারখানায় একদিকে দক্ষ জনবলের অভাব, অন্যদিকে বরাদ্দের ঘাটতি। নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ। বহুদিন ধরেই চলছে এমন দুরবস্থা। বর্তমানে অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেন ১০ থেকে ১৪টি কোচ দিয়ে পরিচালনা করা হয়। এর ফলে ইঞ্জিন ও লোকবলের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ জন্য প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে ১৮ থেকে ২০টি বগি নিয়ে চলাচল নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে জ্বালানি খরচ না বাড়িয়ে আয় বাড়ানো সম্ভব। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর চলাচলের পথ মূল্যায়ন করা দরকার। অর্থাৎ যেসব পথে যাত্রী কম, সেই পথ থেকে ট্রেন কমিয়ে অন্য পথে চালানো।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, রেল ইঞ্জিন সংকটের কারণে ইতোমধ্যে কনটেইনার পরিবহন কমেছে ৫০ হাজার টিইইউএস, আয় কমেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তেল, খাদ্য ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনে ক্ষতি প্রায় ২৫ কোটি টাকা। মেইল ও লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার কারণে যাত্রী ও লাগেজ ভ্যানে আয় কমেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিবছর অন্তত ১০০ কোটি টাকা আয় কমছেÑ যা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল ক্ষতি। এখন ১ টাকা আয় করতে ব্যয় হয় ২ টাকা ৫৮ পয়সা। ব্যয় কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। জনগণের ওপর চাপ না বাড়িয়ে রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় কমানো, লোকসানি পথে (রুট) ট্রেনের চলাচল কমিয়ে লাভজনক পথে তা বাড়ানো; রেলের বিপুল ভূসম্পত্তি ইজারা (লিজ) দিয়ে আয় করার ওপর জোর দিতে চায় রেলওয়ে।