একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

দশমিনা প্রতিনিধি
০২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫২
শেয়ার :
একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

একই আঙিনায় পাশাপাশি রয়েছে মসজিদ আর মন্দির। দুই ধর্মের দুই তীর্থস্থানের মাঝখানে ৩০ ফুট দূরত্ব থাকলেও দুই ধর্মের মানুষের অন্তরে বিন্দুমাত্র দূরত্বের সৃষ্টি হয়নি। প্রায় শতবর্ষ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পটুয়াখালীর দশমিনার বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের বড় গোপালদী গ্রামের বাসিন্দারা।

জানা যায়, উপজেলার বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড বড়গোপালদী বাজারের প্রাণকেন্দ্রে দশমিনা-পটুয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত আলহাজ্জ্ব আবুল হোসেন পঞ্চায়েত জামে মসজিদ। মসজিদটির মাত্র ৩০ ফুট উত্তরেই বড়গোপালদী বাজার সার্বজনীন দূর্গা মন্দির। এর পাশেই রাধা গোবিন্দ মন্দির, কালি মন্দির, লোকনাথ মন্দির ও সীতা মন্দিরসহ একাধিক মন্দির রয়েছে। 

আরও জানা যায়, প্রায় শতবর্ষ আগে এখানে মসজিদটি ও মন্দিরগুলো স্থাপিত হয়। যুগ যুগ ধরে একই আঙিনায় চলছে দুই ধর্মের উপাসনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বের অনন্য এক দৃষ্টান্ত এটি। দুই ধর্মাবলম্বীদের মাঝে নেই কোনো মতবিরোধ। শান্তিপূর্ণভাবেই যার যার ধর্ম পালন করছেন মুসলমান ও সনাতন ধর্মালম্বীরা। একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তারা। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাস্প কখনও আঁচড় কাটতে পারেনি এখানে। পাশাপাশি অবস্থানে যে যার ধর্ম পালন করছেন নির্বিঘ্নে।

গত সোমবার রাতে সরেজমিনে দেখা যায়, এশার আযানের ধ্বনি শুনে মসজিদে ছুটে আসছেন মুসুল্লিরা। মহান আল্লাহর আনুগত্য লাভের আশায় আদায় করছেন নামাজ। এদিকে মসজিদের পাশেই মন্দিরে চলছে শারদীয় দূর্গোৎসবের জাঁকজমক আয়োজন। প্রতিমা দর্শনে ভিড় করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আযান শুরুর বেশ কিছু সময় আগেই থেমে যায় মন্দিরের বাদ্য, বাজনা ও উলুধ্বনি। নামাজ শেষ হলে ঢোলের তালে মুখরিত হয়ে ওঠে দূর্গা পূজার মন্ডপ। আযান ও নামাজের সময়সূচি মেনে বন্ধ রাখা হয় বাদ্য, বাজনা ও উলুধ্বনি।

মসজিদ ও মন্দির কমিটি সূত্রে জানা যায়, উভয় কমিটির লোকজন একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন কিভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

দুই ধর্মাবলম্বীর একাধিক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে জানান, এখানে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। দুই ধর্মের মানুষজনই তাদের নিজ নিজ ধর্ম কর্ম পালন করেন নির্বিঘ্নে। কেউ কাউকে বাধাগ্রস্ত করেন না। বরং যতটুকু পারেন সহায়তা করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি শাইরুল ইসলাম পঞ্চায়েত আমাদের সময়কে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখিনি আমরা। এখানে একই আঙিনার দুইপাশে মসজিদ এবং মন্দির। মাঝখানে মাত্র ৩০ ফুট দূরত্বের ফাঁকা জায়গাটুকুতে কোনো দেয়ালও নেই। আমরা সবসময় সম্প্রীতির বন্ধনে এখানে বসবাস করে আসছি। হিন্দু-মুসলিমদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এই সংস্কৃতি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাদের দূর্গা পূজাসহ সকল পূজা ও ধর্মীয় উৎসবে যাতে কোনো প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সচেষ্ট আছি এবং থাকব।’

ওই মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জাকোয়ান বলেন, ‘আমরা সকলেই স্বাধীনভাবে আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে যাচ্ছি। কখনোই আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি।’

উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পাশাপাশি মসজিদ এবং মন্দির সচরাচর দেখা যায় না। এটি একটি অপূর্ব সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন। আমার বলতে গর্ব হচ্ছে, এটা উপজেলার একমাত্র আমার গ্রামেই রয়েছে।’

বড়গোপালদী বাজার সার্বজনীন দূর্গা মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি গোপাল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘শত বর্ষ পূর্ব থেকেই এই এলাকায় আমাদের দুই ধর্মাবলম্বীদের পূর্বসুরীরগণ একইভাবে অবস্থান করে আসছেন। আমরা হিন্দুরা নির্বিঘ্নে আমাদের ধর্ম পালন করে আসছি এবং মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করছে। আমাদের এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময়ই অক্ষুন্ন ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আযান ও নামাজের সময় আমরা আমাদের মন্দিরে শব্দ হয়, এমন কার্যক্রম বন্ধ রাখি।’

মন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্য নিত্য গোপাল দেবনাথ বলেন, ‘আমরা উভয়ে উভয়ের ধর্মকে সম্মান জানিয়ে যার যার ধর্মীয় প্রার্থনা ও উৎসব পালন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। এখানে আমাদের দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্পর্কের কোনো অবনতি নেই।’

পূজায় আসা কলেজ ছাত্রী ঐশি রাণী বলেন, ‘এখানে কারো মধ্যে সামান্যতম ঈর্ষা কাজ করে না অন্য ধর্মের প্রতি। এখানে পারস্পরিক যে সহাবস্থান, আমি মনে করি এটি মানব জাতির জন্য একটি শিক্ষনীয় বিষয় এবং অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত।’

দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এভাবেই বজায় থাকবে এমন প্রত্যাশা দশমিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল আলীমের। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে আমি অনেক জায়গায় চাকরি করেছি। কিন্তু এই ধরনের মন্ডপ আমি পাইনি। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’

দশমিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইরতিজা হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। যার দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে। তেমনই এক নিদর্শন রয়েছে উপজেলার বড়গোপালদী বাজারে। এখানে পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করছেন মুসলিম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ।’