খাগড়াছড়িতে ধর্ষণকাণ্ডের রিপোর্ট নিয়ে মুখে কুলুপ
স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন
খাগড়াছড়িতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জনজীবন। সহিংসতায় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের মামলা করার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। তবে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় মামলার মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রশাসন। ওই রিপোর্ট নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লেও মুখ খুলছে না জেলার সিভিল সার্ভিস অফিস। রিপোর্ট তৈরি হলেও কথা বলতে রাজি হয়নি জয়া চাকমার নেতৃত্বাধীন মেডিক্যাল বোর্ড।
সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, খাগড়াছড়ির ধর্ষণ ঘটনাকে পুঁজি করে পাহাড়ি এলাকা অশান্ত করার পরিকল্পনা করেছে ইউপিডিএফ। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। পরে গুইমারায় সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। এ ঘটনার প্রভাব তিন পার্বত্য জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার এ উদ্যোগ একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। জাতীয় নির্বাচনসহ সামনে দেশের বড় কিছু ঘটনা রয়েছে- সেগুলো বানচালের জন্য ইউপিডিএফ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ির ঘটনা নিয়ে গত সোমবার রাতে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ নামে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার বৈঠক হয়েছে। খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক উপদেষ্টা তাদের দাবিগুলো মানার আশ্বাস দিয়েছেন। ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবির বিষয়ে বলা হয়েছে- পাহাড়ে জুম্ম ছাত্র-জনতার চলমান অবরোধ তুলে নেওয়ার পর ১৪৪ ধারা
তুলে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, নিহতদের সৎকারে দ্রুত সহায়তা দেওয়া হবে। ধর্ষণকা-ে জড়িত পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। পরে জুম্ম ছাত্র-জনতার ফেসবুক পেজে দেওয়া বিবৃতিতে পার্বত্য উপদেষ্টা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককে স্বাগত জানানো হয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে- ‘এই আলোচনার মাধ্যমে সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক সংলাপের যে সূচনা হয়েছে, সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এটি কোনোভাবে আমাদের অধিকার ও অভ্যুত্থান খালি কথায় গৃহীত হবে, তা নয়।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, খাগড়াছড়িতে সহিংসতার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। খাগড়াছড়ি ও গুইমারার ঘটনার উদ্দেশ্য ছিল দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে যেন না হয়। কিন্তু সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করা হয়েছে। পাহাড়ে পূজা ভালোভাবে হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা সব জায়গায় চেষ্টা করবে। দেশে ও দেশের বাইরে থেকেও কিছু মদদদাতা রয়েছে। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি ঘুরে দেখা গেছে, শহর ও গুইমারায় অধিকাংশ দোকানপাট খোলা হয়নি। সীমিত আকারে কিছু ইজিবাইক চলাচল করছে। কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া স্থানীয়রা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা গতকাল গুইমারার রামসুবাজার এলাকায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সহায়তা বিতরণ করেছেন।
গুইমারা থানার ওসি এনামুল হক চৌধুরী জানান, সহিংসতায় নিহত তিন পাহাড়ির মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর সোমবার রাতে তাদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। এলাকায় সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। খাগড়াছড়ি পৌরসভা, সদর উপজেলা ও গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে।
জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন- আমরা বলেছি, তারা অবরোধ প্রত্যাহার করলে আমরাও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নির্দেশনা তুলে নেওয়া হবে।
খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক মারমা ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে মামলা করেন। এ ঘটনা কেন্দ্র করে গুইমারাতে সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয় দোকানপাট। সংঘর্ষে তিন মারমা তরুণ নিহত এবং সেনা অফিসারসহ ১১ সেনা সদস্য ছাড়াও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এরই মধ্যে বাড়িঘর পোড়ানোর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক। গুইমারায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।