অনিশ্চয়তায় কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ

আসাদুর রহমান
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অনিশ্চয়তায় কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছর দুই ধাপে পৃথক ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতসহ সংস্কারে ২৮টি সুপারিশ করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্য কমিশন ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। এর মধ্যে বিচার বিভাগীয় সংস্কারে জন্য আটটি বিষয় রয়েছে। এ অবস্থায় বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

এ বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট তানিম হোসেন শাওন আমাদের সময়কে বলেন- আমরা যেসব সুপারিশ করেছি, সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করছে। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সব সংস্কার প্রস্তাব এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আগামী সরকার এসে হয়তো করবে।

২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। সংস্কারের জন্য ২৮ দফা সুপারিশ করে কমিশন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশনের ২৮ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- ১. সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও শৃঙ্খলা ২. অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (পে-কমিশন) বিধিমালা, ২০০৭ এর ৪ বিধির অধীনে পে-কমিশন গঠন এবং বিচারকদের বেতন-ভাতাদি সংক্রান্তে নতুন সুপারিশ প্রণয়ন, বিচারকদের জন্য আচরণবিধি ও বদলি নীতিমালা প্রণয়ন এবং বিচারকদের মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। ৩. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনক্রমে পৃথক সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এসবের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের অধীনে আনয়ন। সে উদ্দেশ্যে বিচার-কর্মবিভাগের

সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন। সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয়ের আওতায় বিচার-কর্মবিভাগের বিচারক ও কর্মচারীদের পারিশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত করা। ৪. আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ। ৫. স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন। ৬. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ। ৭. স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন। ৮. বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান-সংশোধনী। প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলো সংশোধন। ৯. অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো : মামলা ও জনসংখ্যার আলোকে অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ। ১০. বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা। ১১. বিচার কার্যক্রমে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার। ১২. অধস্তন আদালতের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ। ১৩. আদালত ব্যবস্থাপনা, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ১৪. বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘব। ১৫. বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ। ১৬. আইনগত সহায়তা কার্যক্রম; ১৭. বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ১৮. মামলাজট হ্রাস; ১৯. গ্রাম আদালত ২০. মোবাইল কোর্ট ২১. আইনের সংস্কার; ২২. বিচারক ও সহায়ক জনবলের প্রশিক্ষণ; ২৩. আইন পেশার সংস্কার; ২৪. আইন শিক্ষার সংস্কার ২৫. মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ ২৬. বিচারহীনতার সংস্কৃতি ২৭. বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ এবং ২৮. সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন বিষয়ে সুপারিশ করেছে গঠিত কমিশন।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় ধাপের সংলাপে ৮৪টি সুপারিশ নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে আটটি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। সেগুলো হলো- প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা, সুপ্রিমকোর্টেও বিচারক নিয়োগ, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন-সংক্রান্ত বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুপ্রিমকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, বিচারকদের পদের মেয়াদ ও তাদের অপসারণ এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সাভিস গঠন। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়েও সংলাপে অংশ নেওয়া একাধিক রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট ও আপত্তি রয়েছে।

সংস্কার প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম আমাদের সময়কে বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কার করতে হলে আগাগোড়া ভেঙেচুরে করতে হবে। সেটা কতদূর করতে পারবে জানি না। তবে সংস্কারের প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কার জন্য ভালো বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। দ্রুত বিচারকাজ শেষ করতে সুদক্ষ ব্যক্তিদের বিচারকাজে নিয়োজিত করতে হবে, যিনি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবেন।

আহসানুল করিম আরও বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন। লিখিত শর্তের ভিত্তিতে বিচার বিভাগ চলে না, চলে বিচারকদের ন্যায়ভিত্তিক বিবেকের ওপর। লিখিত সংস্কারের পাশাপাশি বিচার বিভাগ পরিচালনাকারীদের মানসিক সততার ওপর তাগিদ দেন এই আইনজীবী।

এদিকে স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষ আনয়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর অভিভাষণ দেন। অভিভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এক বছরের মাথায় গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ জানিয়েছেন, ঘোষিত রোডম্যাপের ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। জানা গেছে, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়টিও বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনও প্রক্রিয়াধীন।

এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট আগামী ৩ মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতকরণে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন- বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।

এদিকে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে- উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রণয়ন, বিচার সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা আনয়নে ১২ দফা নির্দেশনা, পেপার ফ্রি বেঞ্চ চালু, লিগ্যাল এইড প্রদানে ক্যাপাসিটি টেস্ট চালু, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত চালুকরণ, জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ২৩২টি পদ সৃজণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্গঠন, সুপ্রিমকোর্ট ও সারাদেশের আদালতে হেল্পলাইন চালু, বিচারকদের সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন, আদালত প্রাঙ্গণসহ বিচারকগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কার করা হয়েছে।