সংকটেও এবি ব্যাংকের ওপর আস্থা রেখেছেন গ্রাহকরা
দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে এবি ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৮২ সালের ১২ এপ্রিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে এলেও বিগত সরকারের আমলে লুটপাটের শিকার হয়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য কিছুটা খারাপ হয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অভিজ্ঞ ব্যাংকার সৈয়দ মিজানুর রহমান। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংকটির আমানত, হিসাবধারীর সংখ্যা, রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি হচ্ছে। তবে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে আরও সময় লাগবে। এসব বিষয়সহ ব্যাংক খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে সম্প্রতি দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন সৈয়দ মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার জিয়াদুল ইসলাম।
আমাদের সময় : প্রবেশমুখে ‘আস্থার ৪৩ বছরে এবি ব্যাংক’- এমন একটি প্রচারণা চোখে পড়ল। গ্রাহকদের আস্থা এলে কতটা অর্জন করতে পেরেছে এবি ব্যাংক?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : গ্রাহকদের আস্থা অবশ্যই অর্জন হয়েছে। কারণ কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি হলে, সেই ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখতে চায় না। এবি ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপিঋণ এখন প্রায় ৬৭ শতাংশ। এই চিত্র সামনে আসার পরও আমাদের আমানত কমেনি, বরং বেড়েছে। চলতি বছরের আট মাসে নতুন আমানত সংগ্রহ হয়েছে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। নতুন হিসাব খোলা হয়েছে ৩১ হাজারেরও বেশি। এর মানে গ্রাহকরা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। গ্রাহকদের এই আস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।
আমাদের সময় : এবি ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলবেন?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : বর্তমানে পুরো ব্যাংক খাত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। তবে আশার কথা হলো- আট মাস আগে যে অবস্থায় ছিল ব্যাংকিং খাত, এখন আর সেই অবস্থায় নেই। সবাই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অন্যান্য ব্যাংকের মতো এবি ব্যাংকও চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। তবে অন্য ব্যাংকের মতো এবি ব্যাংকে টাকা তুলতে এসে কেউ কখনো ফেরত যাননি। এমনকি যখন দেশে ডলার সংকট ছিল, এলসি বন্ধ ছিল, তখনও এর কোনো প্রভাব ব্যাংকে পড়েনি। গত আট মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার। এ সময়ে আমদানি এলসি করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০২ কোটি টাকার। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি ও অন্যান্য পদক্ষেপ চলছে, এ বছরের মধ্যে এর ফলাফল দেখা যাবে।
আমাদের সময় : বিগত সময়ে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাত না ব্যাংকগুলো, এর কারণ কী?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপের কারণে বিগত সময়ে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখানো যায়নি। বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে এক প্রকার জিম্মি ছিল ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। তাদের জন্যই নীতি তৈরি হতো। এমনকি প্রভাবশালী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে অতীতে দুবার চিন্তা করতে হয়েছে। এর বাইরে প্রত্যেক ব্যাংকেরই শেয়ারধারীর কাছে একটা জবাবদিহি রয়েছে। এখন আমি যদি ব্যাংকের খারাপ জিনিসটাকে তুলে ধরি, তাহলে আমি একাই খারাপ হচ্ছি। ফলে এখানে ভাবমূর্তির বিষয় রয়েছে। আবার একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য আসেন। ফলে নিজের মেয়াদকালে ব্যাংকের ভালো দিকগুলোই প্রকাশ্যে আনেন। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বেশি হলে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। এসব কারণে অতীতে অনেক ব্যাংকই খেলাপি ঋণ গোপন রেখেছিল। তবে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ও কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষাপটে লুকানোর প্রবণতা কমেছে। এখন সবাই খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাচ্ছে।
আমাদের সময় : খেলাপি ঋণ আদায়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। কোনো আইনি চালেঞ্জ আছে কি?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য একটি টাস্কফোর্স ও বিশেষ পুনরুদ্ধার দল গঠন করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ফলোআপ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা ছোট গ্রাহকদের থেকে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। একই সঙ্গে বড় গ্রাহকদের থেকে অর্থ উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। গত পাঁচ মাসে আমরা প্রায় ১৬শ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছি। বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে ১২শ মামলা চলমান, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। সমস্যা হলো- মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় ভুগছে। আমরা একটি মামলা করলেই গ্রাহক আরেকটি মামলা করে দেন, ফলে নিষ্পত্তি হতে বছর কেটে যায়। এ সমস্যা সমাধানে বিচার ব্যবস্থার গতি বাড়ানো, অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মামলার নিষ্পত্তির সময় কমানো দরকার। প্রয়োজনে ১০টি বিশেষ আদালত করা যেতে পারে। যদি আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, তাহলে খেলাপি ঋণ আদায়ও অনেক সহজ হবে।
আরও পড়ুন:
ছায়ানটের বার্ষিক লোকসংগীত আসর
আমাদের সময় : এবি ব্যাংকের সম্পদ যাচাই (একিউআর) নিয়ে কী বলবেন?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ডেলয়েট তিনটি ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) করছে। এই নিরীক্ষা শুধু এবি ব্যাংকের জন্য নয়। এর আগে চারটি ব্যাংকের কাজ শেষ হয়েছে। এখন তিনটি ব্যাংকের হচ্ছে এবং পরে আরও আটটি ব্যাংকে হবে। এটি মূলত আইএমএফের শর্তের অংশ। আমাদের প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি যাচাই করতেই এই নিরীক্ষা করানো হচ্ছে। তাই জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের সময় : ঘুরে দাঁড়াতে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই?
সৈয়দ মিজানুর রহমান : আমরা ভবিষ্যতে করপোরেট থেকে ফোকাসটা সরিয়ে ফেলব। আমার মোট ঋণের ৯০ শতাংশের বেশি করপোরেট। এটা অনেক বড় ঝুঁকি তৈরি করে। সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখলে একটি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হওয়ার কথা। তাই আমরা এখন এসএমই এবং রিটেইল ব্যাংকিংয়ে ফোকাস করছি। সেই সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা বাড়ানোর বিষয়ে ফোকাস করছি। এতে ব্যাংকের তহবিল খরচ কমবে, ব্যাংকের সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এ ছাড়া বেশ কিছু শাখাকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চাচ্ছি, যাতে গ্রাহকরা আরও নির্বিঘেœ সেবা পেতে পারে। কিছু শাখার জনবলের যৌক্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। সামগ্রিকভাবে জনবলের মানোন্নয়নেও জোর দেব।
আরও পড়ুন:
বরিশালে ৯ ছাগলের সাজা মওকুফ