আসামের রাজা আসামের আবেগ জুবিন গার্গ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংস্কৃতিতে যার নাম এক আবেগের সমার্থক, তিনি জুবিন গার্গ। কেবল একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন একাধারে সংগীত পরিচালক, অভিনেতা, সমাজকর্মী এবং এক ক্ষণজন্মা শিল্পী, যিনি তার বহুমুখী প্রতিভা আর বিদ্রোহী মনোভাব দিয়ে গোটা অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে মর্মান্তিক স্কুবা ডাইভিং দুর্ঘটনায় তার আকস্মিক প্রয়াণ যেন এক কিংবদন্তির অসমাপ্ত সুর। বিস্তারিত লিখেছেন আজহারুল ইসলাম রবি
জুবিন গার্গের পরিচয় ও জীবনবৃত্তান্ত
জুবিন গার্গ (Zubeen Garg), যার পুরো নাম ছিল জুবিন বরঠাকুর, ছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিল্পী। তাকে সাধারণত ‘লুইতকণ্ঠ’ এবং ‘অসমের হার্টথ্রব’ নামে অভিহিত করা হতো।
জন্ম ও পরিবার : জুবিন গার্গ ১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর মেঘালয়ের তুরা শহরে একটি অসমীয়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল মোহনী মোহন বরঠাকুর এবং মায়ের নাম ইলি বরঠাকুর। তার শৈশবের নাম ছিল ‘গ’ল্ডি’। তিনি ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার বোনও সংগীতশিল্পী ছিলেন, কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার অকালমৃত্যু জুবিনের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
বহুমুখী প্রতিভা : তিনি কেবল একজন কণ্ঠশিল্পীই ছিলেন না, বরং একাধারে ছিলেন সংগীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকার, সংগীত ব্যবস্থাপক, চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, বাদ্যযন্ত্রী ও সমাজকর্মী। তিনি কি-বোর্ড, গিটার, তবলা, ম্যান্ডোলিনসহ একাধিক বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।
ভাষা ও গানে অবদান : জুবিন তার দীর্ঘ ৩৩ বছরের সংগীতজীবনে অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মারাঠিসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় প্রায় ৩৮,০০০-এরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন, যা তাকে একজন বিরল শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
জুবিনের সংগীতজীবন
জুবিন গার্গের পেশাদার সংগীতজীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৯২ সালে, যখন তিনি তার প্রথম অসমীয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা’ মুক্তি দেন।
প্রাথমিক অর্জন : ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ‘যুব মহোৎসব’-এ পাশ্চাত্য একক পরিবেশনায় স্বর্ণপদক লাভ করার পর তার সংগীতজগতে পথচলা আরও সুগম হয়। এই সাফল্য তাকে পেশাদার সংগীতজগতে প্রবেশের সাহস জোগায়।
আসামের সংগীতে বিপ্লব : জুবিন আসামের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত, বিহু এবং আধুনিক সংগীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি অসমীয়া সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তার গানগুলোতে আবেগ এবং আঞ্চলিকতার একটি বিশেষ গন্ধ থাকত, যা তাকে অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘রকস্টার’-এর খ্যাতি এনে দেয়।
৪০ হাজারেরও বেশি গান : তিনি অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিসহ বহু ভাষায় মোট ৩৮,০০০ থেকে ৪০,০০০-এর বেশি গান রেকর্ড করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সিনেমায় প্রথম গান
জুবিন গার্গ বলিউডে তার প্রথম পরিচিতি লাভ করেন ২০০৬ সালে মহেশ ভাটের আলোচিত সিনেমা ‘গ্যাংস্টার’-এর মাধ্যমে।
‘ইয়া আলি’ (Ya Ali) : এই সিনেমায় তার গাওয়া ‘ইয়া আলি’ গানটি তাকে রাতারাতি সর্বভারতীয় তারকার পরিচিতি এনে দেয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানটির জন্য তিনি গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (GIFA) এবং স্টারডাস্ট অ্যাওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী (পুরুষ) পুরস্কার লাভ করেন।
বলিউড ও বাংলা সিনেমা : ‘গ্যাংস্টার’-এর পর তিনি ‘ফিজা’, ‘রাজ’, ‘থ্রিডি’, ‘কৃষ থ্রি’-এর মতো জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বাংলা চলচ্চিত্রেও কণ্ঠ দিয়েছেন এবং সুরারোপ করেছেন। ‘শুধু তুমি’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে ২০০৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন।
জুবিন কেন আসামের মানুষের কাছে আবেগ
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
আসাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে জুবিন গার্গ কেবল একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘একটি আবেগ’ এবং ‘একটি যুগের প্রতীক’। তার জনপ্রিয়তা গভীর এবং বহুমাত্রিক হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো :
সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার : তিনি অসমীয়া ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীতে গভীরভাবে নিবেদিত ছিলেন। তিনি আঞ্চলিক গানকে সর্বভারতীয় ও বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।
সহজ-সরল ও বিদ্রোহী স্বভাব : জুবিন ছিলেন স্বভাবতই স্পষ্টবাদী ও বিদ্রোহী। তিনি বাঁধাধরা নিয়ম মানতে চাইতেন না এবং যেকোনো সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুতে জনসমক্ষে নিজের মতামত জানাতে দ্বিধা করতেন না। তার এই ‘অপ্রতিরোধ্য সাহস’ এবং ‘কাছের মানুষ’-এর মতো আচরণ তাকে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে দেয়।
কাঁচা আবেগ : তার গানগুলোতে যে কাঁচা আবেগ, জীবনসংগ্রাম ও অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটত, তা শ্রোতাদের গভীরভাবে সংযুক্ত করত।
অকালপ্রয়াণ : ভক্তদের মতে, ভূপেন হাজারিকার পর জুবিন গার্গই আসামের সংস্কৃতিকে নতুন পথ দেখানো শিল্পী। তার এই অকালপ্রয়াণ মানুষকে আরও বেশি শোকাহত করেছে।
মাটির গন্ধ : তার গানে থাকত আঞ্চলিকতার একটি বিশেষ সুর, যা সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, আশা-আকাক্সক্ষা এবং ‘র-ইমোশন’ (কাঁচা আবেগ) তুলে ধরত।
জুবিন গার্গকে তার অঞ্চলের মানুষ কেবল গান দিয়ে নয়, তার ব্যক্তিত্ব ও বিদ্রোহের জন্য ভালোবাসত। তাকে বলা হতো ‘লুইতকণ্ঠ’।
যতগুলো সিনেমায় জুবিন গান করেছেন
জুবিন গার্গ তার কর্মজীবনে হিন্দি, বাংলা, অসমীয়া, তামিল, তেলুগু, কন্নড়সহ বহু ভাষার অসংখ্য চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন এবং সুরারোপ করেছেন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন হলেও তিনি বহু সিনেমায় গান করেছেন। উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা হলো :
হিন্দি : গ্যাংস্টার, ফিজা, রাজ, কৃষ থ্রি, ডার্টি পিকচার, থ্রিডি।
বাংলা : শুধু তুমি, রংবাজ, খিলাড়ি, খোকা ৪২০, বোঝে না সে বোঝে না।
অসমীয়া : দীনবন্ধু, ইয়ারিংগম, মিশন চায়না (অভিনয় ও সংগীত), কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তিনি বহু অসমীয়া চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন।
গানে অকালপ্রয়াত বোনের প্রভাব
জুবিনের জীবনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল তার বোন জংকীর অকালমৃত্যু। ১৮ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বোনকে হারানোর পর জুবিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তার অনেক গানেই এই বেদনার ছাপ পাওয়া যায়। তার ঘনিষ্ঠজনদের মতে, এই ট্র্যাজেডি জুবিনের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আরও পড়ুন:
নানাকে নিয়ে পরীর আবেগঘন পোস্ট
জুবিনের জীবনের কিছু মজার ঘটনা
জুবিন গার্গের জীবন ছিল বেশ বর্ণময় এবং বিতর্কিতও। তার কিছু স্বভাবসুলভ ঘটনা তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছিল :
মঞ্চে মদ্যপান ও বেপরোয়া আচরণ : জুবিন জনসম্মুখে তার মদ্যপানের অভ্যাস নিয়ে অকপট ছিলেন এবং বহুবার মঞ্চে উঠে মদ্যপ অবস্থায় গান গেয়েছেন, এলোমেলো গিটার বাজিয়েছেন, এমনকি কোনো কোনো দিন মদের তোড়ে আর গান গাইতে না পেরে ঘুমিয়েও পড়েছেন। তার ভক্তরা এটিকে তার ‘বিদ্রোহী’ স্বভাবের অংশ হিসেবেই দেখতেন।
রাজনীতিবিদদের সরাসরি সমালোচনা : তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে খুবই মুখর ছিলেন এবং মঞ্চে বা জনসমক্ষে রাজনীতিবিদদের সরাসরি একহাত নিতে দ্বিধা করতেন না, যা জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়েছিল।
জুবিনের ধর্মীয় মতাদর্শ
জুবিন গার্গ একটি অসমীয়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হিসেবে পরিচিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না।
ধর্মীয় সহাবস্থান : তিনি বিভিন্ন ধর্মে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তার গান ও জীবনে এর প্রতিফলন দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, তার জনপ্রিয় গান ‘ইয়া আলি’ একটি সুফি ঘরানার গান, যা তার ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দেয়।
মানবতাবাদে বিশ্বাস : জুবিন ছিলেন একজন মানবতাবাদী শিল্পী। তিনি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ প্রকাশ করতেন, যা তার সামাজিক কর্মকাণ্ডেও দেখা যেত।
মুম্বাইয়ের মোহ ত্যাগ করেছিলেন যে কারণে
বলিউডে ‘ইয়া আলি’-এর মতো সুপারহিট গান উপহার দেওয়ার পরও জুবিন গার্গ মুম্বাইয়ে স্থায়ী হননি। এর পেছনে ব্যক্তিগত একটি কারণ ছিল।
মুম্বাইয়ের ‘অহংকারী’ মানসিকতা : এক সাক্ষাৎকারে জুবিন জানিয়েছিলেন, মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘দাম্ভিক মনোভাব’ (Attitude) তার পছন্দ হয়নি। তিনি অনুভব করেছিলেন, বলিউডে কাজ করার পরিবেশ তার জন্য উপযুক্ত নয়।
আসামে ‘রাজা’ হয়ে থাকা : জুবিন বলেন, ‘আসামে আমি রাজার মতো থাকি, কিন্তু বলিউডে আমাকে কেবলই একজন গায়ক হিসেবে থাকতে হবে।’ তিনি তার জন্মভূমিতে ফিরে এসে আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও সংগীতে মনোনিবেশ করেন, যেখানে তিনি তার শিল্প ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখতে পারতেন। মুম্বাইয়ের আরামের জীবন টানত না জুবিনকে। তার হৃদয়ে ছিল আসাম। এখানেই জীবনের শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন জুবিন।
মুম্বাইয়ে কাটানো বছরগুলোর স্মৃতি টেনে এক পডকাস্টে জুবিন বলেন, ‘আমি ১২ বছর মুম্বাইয়ে ছিলাম, শহুরে জীবন আমাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। অনেকে জিজ্ঞেস করে, কেন মুম্বাইয়ে থাকি না? আমি বলেছি, রাজা কখনও নিজের রাজ্য ছেড়ে যায় না। ওখানে কোনো রাজা নেই।
আমি যদি আসামে মারা যাই, আসাম ৭ দিন থমকে যাবে
নিজের মৃত্যুতে আসামের মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা আগেই বলেছিলেন তিনি। ভবিষ্যদ্বাণী করে জুবিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি আসামে মারা যাই, আসাম ৭ দিন থমকে যাবে।’ শেষযাত্রায় আসাম থেকে সে ভালোবাসাই যেন পেয়েছিলেন জুবিন। তার মৃত্যুতে যেন সবকিছুই থেমে গিয়েছিল। এই উক্তিটি ছিল তার নিজের জনপ্রিয়তা ও ভক্তদের প্রতি ভালোবাসার এক সুস্পষ্ট প্রতিফলন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, তার অঞ্চলের মানুষ তাকে কত গভীরভাবে ভালোবাসে। তার মৃত্যুর পর এই উক্তিটি সত্যে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
‘এভাবে বিয়ে করা নাকি অর্থহীন’
সিঙ্গাপুর থেকে তার মরদেহ গুয়াহাটিতে আনার পর থেকে শেষকৃত্য পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। তার শেষকৃত্যের এই জনস্রোতটি লিমকা বুক অব রেকর্ডসে ঠাঁই পেয়েছে, যা প্রমাণ করে জুবিন কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অসমের গণ-আবেগের প্রতীক।
মানবিক জুবিন
খ্যাতি পেয়েও ছিলেন মাটির মানুষ : বলিউডে জনপ্রিয়তা, অর্থ ও খ্যাতি পেয়েও জুবিন ছিলেন সরল, অকৃত্রিম এবং মানুষের কাছাকাছি। নাম-যশ হলেই যেখানে সেলিব্রিটিরা চলে যেতেন মুম্বাই সেখানে জুবিন বাস করতেন নিজের পৈতৃক ভিটায়। সাধারণ মানুষের মতোই। যে কেউ যে কোনো সময় তার দেখা পেত, তার সান্নিধ্যে যেতে পারত। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার : যখন অন্যরা নীরব ছিলেন, তখন জুবিন গার্গ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছিলেন একাই। মানুষ তাকে চিনেছে ব্যতিক্রমী এক প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে, যিনি নিজের স্বার্থের কথা কখনও ভাবতেন না। এই স্বার্থহীনতার আদর্শ জুবিনকে সব সময় অনন্য করে রাখবে।
মানুষের বিপদে জুবিন : বন্যার ত্রাণ থেকে শুরু করে নানা সামাজিক কাজে তিনি সব সময় এগিয়ে এসেছেন, থেকেছেন মানুষের পাশে।
গাড়ির প্রতি শখ আর পানির প্রতি ভয় ছিল জুবিনের
অনুরাগীদের মতে, জুবিন শুধু একজন গায়ক ছিলেন না, একটা গোটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। অসমীয়া, বাংলা ও হিন্দিসহ একাধিক ভাষায় গান গেয়েছিলেন তিনি। ২০০০ সালের মধ্যে আসামের মানুষের অন্যতম প্রিয় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন জুবিন গার্গ। এর পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ছবির গান এবং অনুষ্ঠানে গান গেয়ে রোজগার করেছেন তিনি। ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুবিনের সম্পত্তির পরিমাণ ৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজ্ঞাপনের কাজ থেকে অর্জিত পারিশ্রমিকও রয়েছে।
তবে মাসে তিনি কত টাকা রোজগার করতেন তার কোনো সঠিক হিসাব কখনও প্রকাশ পায়নি। সেভাবে তিনি অর্থের পেছনে ছুটতেন না বলেই জানা যায়। সব সময় সক্রিয় থাকতেন না। তবে বড় কোনো গানের প্রজেক্ট থাকলে সেখানে ১০০ শতাংশ পরিশ্রম করতেন শিল্পী। সারাবিশ্বে পরিচিতি পেলেও নিজের রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। বড় শহরের হইচই থেকে দূরে শান্তিতে থাকতে পছন্দ করতেন। নিজের বাড়িকেও আসামের তৈরি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন হস্তশিল্প, বাঁশের তৈরি জিনিস এবং হাতে আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন নিজের স্টুডিও।
গাড়ি ও মোটর বাইকের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল তার। মার্সিডিজ বেঞ্জ, রেঞ্জ রোভারসহ বড় সম্ভার ছিল শিল্পীর। বরাবরই রোমাঞ্চ পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু পানিকে ভয় পেতেন। তাই মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠছে, পানিতে ভয় থাকা সত্ত্বেও কীভাবে স্কুবা ডাইভিং করতে নেমেছিলেন তিনি?
অকালপ্রয়াণ : স্কুবা ডাইভিং দুর্ঘটনা
২০২৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানের জন্য গিয়ে সেখানেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর কারণ ছিল স্কুবা ডাইভিং দুর্ঘটনা। সমুদ্রে ডাইভিংয়ের সময় অসুস্থ হয়ে তিনি ডুবে যান। তার মৃত্যুর পর তার দীর্ঘদিনের শারীরিক অসুস্থতা, যেমন- মৃগীরোগ এবং মাঝে মাঝে ‘ব্ল্যাক-আউট’ হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ধারণা করা হয়, স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় হঠাৎ অসুস্থতাই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মূল কারণ। মাত্র ৫২ বছর বয়সে জুবিন গার্গের এই বিদায় উত্তর-পূর্ব ভারতের সংগীতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে গেল। তিনি তার গান, বিদ্রোহ এবং ভালোবাসার মাধ্যমে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।