দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নদী তালিকা শুধু নথিতে

লুৎফর রহমান কাকন
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নদী তালিকা শুধু নথিতে

দখল ও দূষণে মৃতপ্রায় দেশের অধিকাংশ নদী। কাগজে কলমে ১ হাজার ৪১৫ নদীর হিসাব থাকলেও বাস্তবে অর্ধেকের অস্তিত্ব নেই। যেসব নদী এখনও বেঁচে আছে, সেগুলোও অবৈধ দখল, দূষণ আর পানির সংকটে ধুঁকছে। অথচ বছরের পর বছর সভা-সমাবেশ আর পরিকল্পনা চললেও বাস্তবে নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। প্রতিনিয়তই নদী দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।

আজ বিশ্ব নদী দিবস। ১৯৮০ সালে কানাডায় শুরু হয়ে ২০০৫ সালে জাতিসংঘের সমর্থনে দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ২০১০ সাল থেকে। কিন্তু দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা, বাস্তবে নদী বাঁচানোর তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেই। দেশের অধিকাংশ নদী দখল দূষণে বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নদী দখলকারীরা ঐক্যবদ্ধ হলেও সরকার উদাসীন। এমনকি নদী নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে একটা সংস্কার কমিশন না থাকার সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের নদীর যে কি করুণ পরিণতি সেগুলো বুঝতে পারা যায় যখন কাগজে কলমে নদীর হিসাব এবং বাস্তবতা কতগুলো রয়েছে তার তথ্য থেকে। বাংলাদেশে বর্তমানে নদী কমিশনের হিসাবে ১৪১৫টি নদী রয়েছে। এর আগে এক হাজার ৮০০ নদীর কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে তার অর্ধেক নদীও নেই। যেসব নদী আছে সেগুলোও পানি সংকট, দখল দূষণে মৃতপ্রায়। খোদ রাজধানীর চারপাশে চারটি নদী দখল দূষণে বিপর্যস্ত। অথচ বছরের পর বছর নীতিনির্ধারকরা নদীর দখল উচ্ছেদ নিয়ে সভা-সমাবেশ করছে।

গত এক দশক ধরে নদীরক্ষা নিয়ে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে সফলতা খুব কম। সূত্রে জানা যায়, নানা সময় নদীরক্ষা কমিশন থেকে ৬৪ জেলায় দখল হওয়া নদী নিয়ে তালিকা করা হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে, তবে কার্যত তেমন ফল নেই। প্রভাবশালীরা দেশের বিভিন্ন এলাকার নদনদী নানা কায়দায় দখল করেই চলেছে।

দেশে নদ-নদীর অবৈধ দখল নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক আলোচনা হয়েছে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা জেলায় জেলায় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের দিকে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের উদ্যোগে সারাদেশে ৫৭ হাজার ৩৯০ অবৈধ দখলদারের তালিকা করে। এই দখলদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারি সংস্থা ছিল। নদী কমিশনের হিসাবে ২০১৯ সালের ৩২ শতাংশ নদী দখল উচ্ছেদ করে থেমে যায় কার্যক্রম। দখলমুক্ত করার পর আবার অনেক জমি পুনর্দখল করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। এর পরও কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও সেগুলো বন্ধ হয়ে যায় নানা কারণে।

কেন বন্ধ হয়ে যায় নদী দখল উচ্ছেদ? এ বিষয়ে গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, নদী দখলমুক্ত করতে সরকারের উদ্যোগের অভাব থাকলেও আমাদের দেশে নদী দখলকারীদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, বর্তমান সরকারও নদীরক্ষায় কোনো সংস্কার কমিশন করেনি। অথচ নদী হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের অংশ এবং অস্তিত্বই থাকবে না যদি নদী না থাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো ধ্বংসে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করেও সফলতা মিলছে না। তিনি বলেন, সরকারের একটা সহজ কাজ ছিল নদী নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সংযুক্ত করা,

১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করা। সরকার এসব কাজ করতে পারেনি। ভারত যেহেতু এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি সেহেতু বাংলাদেশের করা উচিত বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, নদীর পানিবণ্টনে ভারত কখনও বহুপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নিতে চায় না। বাংলাদেশের নদী বিপর্যয়ের তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো হলো ভারতের নদী আগ্রাসন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদী বিধ্বংসী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিভিন্ন ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দখল ও দূষণ।

এদিকে গতকাল শনিবার বিশ^ নদী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর পান্থপথে নদী ভবনে পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পানিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে এক এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যে নদী রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নদী নিয়ে নানা মতানৈক্য রয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চলতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় নদী কর্মীসহ সবার সহযোগিতায় নদীর তালিকা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১৪১৫টি নদী রয়েছে। সুন্দরবন এবং পাহাড়ি এলাকার নদী নিয়ে গবেষণা করবে যৌথ নদী কমিশন। যেসব নদী বাদ পড়েছে সেগুলো যাচাই করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমাদের নিজের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে হবে। কিছু নদী আছে সংকটাপন্ন, কিছু আছে আন্তঃসীমান্ত নদী। তিস্তা এবং গঙ্গা নিয়ে বৃহৎ পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছে সরকার।

সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, সেন্টমার্টিন আমাদের জাতীয় সম্পদ, সেন্টমার্টিন বাঁচলে পর্যটন বাঁচবে। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে পর্যটন কখনই বন্ধ করা হয়নি, প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

চলনবিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে বিলে! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা লেখাপড়া করেন, তাঁরা কেমন করে এ দাবি তুলতে পারেন, এ দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে পারেন বা প্রস্তাব পাঠাতে পারেন?’

আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সরকার অনুমতি দিল কী দিল না, সেটা পরে, আপনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এই প্রকল্প আদৌ পাঠাতে পারেন কিনা, এটাই তো হলো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, সারাদেশে কতগুলো খাল রয়েছে, তা জানার জন্য জেলা থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছিল। ২৯টি জেলা তালিকা দিয়েছে। জেলাগুলোর তালিকায় দেখা যায়, খাল হয়তো রেকর্ড আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই। দেখা যাচ্ছে, খালের মধ্যে ডায়াবেটিক হাসপাতাল দাঁড়িয়ে আছে।