৮৬ শতাংশ ধর্ষণকারীই ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত
পূর্বপরিচিত কিংবা নিকটাত্মীয়র মাধ্যমে দেশে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অতি দরিদ্র থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষই এই অপরাধে জড়াচ্ছে কিংবা এর শিকার হচ্ছেন। অসাবধনতা কিংবা সরলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিলম্বিত বিচার ও প্রভাবিত তদন্তের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। আইনজীবীরা মনে করেন, দেশের ধর্ষণবিরোধী আইনটি কঠোর। তবে আইন প্রয়োগে তদন্তকারীর ও রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা রয়েছে। ফলে অধিকাংশ মামলার সর্বশেষ পরিণতি সমঝোতায় গিয়ে ঠেকে। এতে উৎসাহী হয়ে পড়ছে অপরাধীরা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৪টি ধর্ষণের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে পিবিআই। এতে দেখা গেছে, ৭২ জন পরিচিতজন বা নিকটাত্মীয়ের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ৪০ জন ভুক্তভোগী প্রতিবেশীর শিকার। ভুক্তভোগীর ৩৩ জন অতিদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত ৩০ জন। এর মধ্যে ২৭ জনকে নির্জন স্থানে একা পেয়ে ধর্ষণ করা হয়। বিয়ের প্রলোভন, মিথ্যা আশ^াস ও প্রেমের অভিনয় করে ধর্ষণ করা হয় ৪২ জন নারী-শিশুকে। ৪৫টি ধর্ষণের ঘটনা বিবাহিতদের দ্বারা ঘটেছে, যা মোট ঘটনার ৫৪ শতাংশ। ধর্ষণকারীর বয়স ১৩ থেকে ৬৭ বছর। ধর্ষণের শিকার ৭৩ শতাংশ অবিবাহিত, যার ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ও শিশু।
পূর্বপরিচিত ও প্রতিবেশীর মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা এড়াতে অভিভাবকদের সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। প্রলোভন ও ফাঁদের বিষয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের (ঢাবি) সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা আত্মীয়তার সূত্র ধরে পূর্বপরিচত, বন্ধু কিংবা সহকর্মী দ্বারা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই এমন অবস্থা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব তৈরির প্রশ্নে নারীকে সতর্ক হতে হবে। ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। কারণ, বিলম্বিত বিচার ও প্রভাবিত তদন্তের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় বিবাহিত পুরুষ ধর্ষণের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তৌহিদুল হক বলেন, নারীদের সহযোগিতার মাধ্যমে কিংবা প্রলোভনে ফেলতে পারে বিবাহিত পুরুষ। আমাদের সমাজব্যবস্থার কারণে নারীরা একটি নিশ্চয়তা চান। পুরুষ কিছুটা সুযোগ দিয়ে শরীরের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিশুদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সব শিশুকে ভালো স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ শেখাতে হবে। স্কুল ও পরিবার এটা শেখাবে। আর শিশুটি যখন বড় হতে থাকবে, তখন সে সতর্ক হয়ে বন্ধুত্ব নির্বাচন করবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৫২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২৬৬ জনই শিশু। ধর্ষণের পর ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ছয়জন। এসব ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৩৫টি এবং ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ধর্ষণ বা নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইন খুবই কঠোর। তবে আইন বাস্তবায়নে তদন্তকারীর ও রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা রয়েছে। ফলে অধিকাংশ মামলার সর্বশেষ পরিণতি সমঝোতায় গিয়ে ঠেকে। অপরাধ করেও শাস্তি না হওয়ার দৃষ্টান্ত আসামিদের উৎসাহিত করে তোলে। ফলে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো পাশবিক ঘটনা থামানো যাচ্ছে না।
পিবিআইয়ের বিশ্লেষণ বলছে, ধর্ষণ মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন কর্মকর্তারা। এর কারণে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দুর্বল হয়ে যায়। অসম্পূর্ণ অথবা অপর্যাপ্ত তথ্য সম্বলিত এবং ত্রুটিপূর্ণ এজাহার মামলার পরবর্তী তদন্তের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। এ ছাড়া আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব ও প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে। সর্বোপরি আছে ভিকটিমের আস্থাহীনতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস লজ্জা ও ভয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর অবস্থার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে হওয়া মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে না। নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত মামলাগুলো তদন্তের জন্য আলাদা পুলিশ নিয়োগের ব্যবস্থা থাকা উচিত। নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন, ধর্ষণ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশবাসীকে আরও সোচ্চার হতে হবে।
একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, নারী-শিশু নির্যাতন, দমন ও ধর্ষণের আইনটি অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষ যদি সবকিছু ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারে, তাহলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নথিপত্রে তথ্য-প্রমাণাদি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না, যে কারণে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। ধর্ষণের বিচার বছরের পর বছর ঝুলতে থাকলে বাদীপক্ষ সামাজিক নানা ধরনের বাধা হেনস্তার শিকার হয়।