হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য চিঠি

তাবারুল হক
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য চিঠি

শেখ হাসিনার শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এসব টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য এবং তার সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাসহ দশজনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক। তালিকায় শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও রয়েছেন।

যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে- বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ও দুদক পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকসহ নানাভাবে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।

জালিয়াতির মাধ্যমে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার মামলায় শেখ হাসিনা, জয় ও পুতুলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ মহাপরিদর্শককে গত সেপ্টেম্বরে চিঠি পাঠান।

এ ছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী জীশান মীর্জার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।

অন্যদিকে বিতর্কিত শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) এবং তার দুই ভাই এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ ও পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসানের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার রেড নোটিশ জারির আদেশ দিয়েছেন আদালত।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির চিঠিতে দুদক জানায়, শেখ হাসিনা বিদেশে অবস্থান করছেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তার অবস্থান শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করার জন্য আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আদালতের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এজাহারের কপি, চার্জশিটের কপি এবং পূরণকৃত রেড নোটিশ ফরম সংযুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে চিঠিতে। জয় ও পুতুলের বিষয়ে পাঠানো চিঠিতেও একই কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে এবং আসামিকে বিচারের মুখোমুখি করতে রেড নোটিশ জারির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আইজিপির দপ্তরে আলাদাভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দুদকের কর্মকর্তারা জানান, রেড নোটিশ জারির বিষয়ে প্রথমে পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাবে।

গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে অবস্থান করেন শেখ হাসিনা। জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। তাদের পরিবারের অন্যরাও দেশের বাইরে। তাদের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে মোট ৬০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আলাদা ছয়টি মামলার বিচার চলছে। গত ৩১ জুলাই এসব মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালত।

এসব মামলায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির জন্য দুদকের আবেদনে অনুমোদন দেন চট্টগ্রাম মহানগর স্পেশাল জজ আদালত। তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ছাড়াও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বেশকিছু মামলা করেছে দুদক। এসব মামলার তদন্ত চলার সময় রেড নোটিশ জারির আবেদন করে দুদক।

৭৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন ও পাচারের চার মামলায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজের একটি আদালত থেকে বেনজীর আহমেদ ও জীশান মীর্জার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুমোদন দেওয়া হয়। এই নির্দেশনা পেয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে রেড নোটিশ জারি চেয়ে পুলিশের সদর দপ্তরে চিঠি পাঠায় দুদক।

এ ছাড়া ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের এক মামলায় দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) এবং তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গত বুধবার রেড নোটিশ জারির আদেশে অনুমোদন দিয়েছেন আদালত। অনুমোদন পাওয়ার পরদিনই গত বৃহস্পতিবার পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে সেই চিঠি পাঠানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক তাহাসিন মুনাবীল হক গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনজনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছিলেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তারা ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুই ডজন মামলার মধ্যে এ মামলাটি গত ২ জুলাই করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেড) থেকে মেসার্স এ এম ট্রেডিংয়ের নামে ১০৪ কোটি ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকার ঋণ নেওয়া হয়। পরে জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়।

চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তিনি আরও আটটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে এক লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, কেউ নাগরিকত্ব ত্যাগ করলেই তার কৃত অপরাধ থেকে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে সেসব দেশের আইন বিবেচনা করে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছি। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।