ফেসবুক লাইভে এসে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন যুবক

রাজশাহী ব্যুরো
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০:১৬
শেয়ার :
ফেসবুক লাইভে এসে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন যুবক

রাজশাহীতে এবার ঋণের চাপে দিশেহারা হয়ে ফেসবুক লাইভে এসে ঘোষণা দিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন মিঠুন দাস (২৮) নামে এক যুবক। আত্মহত্যার আগে ফেসবুক লাইভে মিঠুন বলেন ‘আমি চলে যাইতেছি। যারা আমার কাছ থেকে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আমি আমার নিজের চোখে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না। সরকারের কাছে একটাই আবেদন, পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, পরিবারটাকে বাঁচায়ে রাইখেন। মা-বাবা ক্ষমা করে দিও। বিউটিকে (স্ত্রী) একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে করাইও।’

মিঠুনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে। বাবা প্রেমানন্দ দাস পেশায় ভ্যানচালক ছিলে। বর্তমানে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসকে বিয়ে করেছিলেন মিঠুন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরিপুর এলাকায়। তিন মাস আগে যোগ দেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা। কিন্তু ঋণের ফাঁদ থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছিলেন না মিঠুন দাস। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি আর সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা থেকে যা আয় হতো, তার প্রায় সবটুকুই চলে যেত শুধু সুদের টাকা মেটাতে।

গত মঙ্গলবার ফেসবুকে লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘কোনদিন ভাবিই নাই এ সিদ্ধান্ত নিব। এর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ক্ষতিটা হইত না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ডিসেম্বর মাস থেকে বিপদ পিছু ছাড়ছে না। কোম্পানির তিন লাখ টাকার মতো হারাই ফেলছি। জানি আমার পরিবারটাকে দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে মা-বাবাকে কীভাবে জানাব?’ পরে রাতেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েন চলন্ত ট্রেনের নিচে। রেখে যান প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। সংসারে এখন উপার্জন করার কেউ নেই। তাই একমাত্র সন্তান হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়া মিঠুনের মা শ্রীমতি রাণী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ঋণ শোধ করবেন কীভাবে সেই দুশ্চিন্তাও চেপে বসেছে।

মিঠুনের মা শ্রীমতি রাণী জানান, গত মঙ্গলবার দুপুরে ছেলে ফোন করে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো ‘মা, ভালো আছো?’ এরপর আর কোনো কথা বলেনি। রাতেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার খবর আসে। গত বুধবার রাত ১টার দিকে মরদেহ আসে। রাতেই বাড়ির পাশের বড়াল নদের তীরে দাফন করা হয়।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আগে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ করতেন মিঠুন। আগাম টাকা নিয়ে অর্ডার দেওয়া ক্যামেরা কিনে লাগিয়ে দিতেন। গত ডিসেম্বরে এক বন্ধুকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলেন ক্যামেরা কেনার জন্য। কিন্তু ওই বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ধারদেনা করে ক্যামেরা কিনে দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। ভুল সংযোগ দেওয়ায় সব ক্যামেরা পুড়ে যায়, আবার জরিমানার টাকা গুণতে হয়। এক কাজেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এরপর কুমিল্লার দাউদকান্দির তিনটি এনজিও থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। আরেক আত্মীয়ের কাছ থেকেও ২ লাখ টাকা ধার নেন। আরেকটি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা, ব্যবসার জন্য সুদে আরও ৫০ হাজার টাকা নেন মিঠুন। রাজশাহীতে স্বর্ণকারের দোকানে গয়না বন্ধক রেখে মা মিঠুনকে দেন ৫০ হাজার টাকা। ফলে সবমিলিয়ে তাকে ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ঋণের কিস্তি মেটাতে না পেরে মিঠুন যোগ দেন ওষুধ কোম্পানিতে। কিন্তু সেখানকার কালেকশন করা টাকা চুরি হয়ে গেলে ভেঙে পড়েন তিনি।

মিঠুনের মা শ্রীমতি রাণী বলেন, ‘আমার আর কোনো ছেলে নাই। ওর বাপ আগে ভ্যান চালাইত, এখন অসুস্থ হয়ে শুইয়া আছে। মাথার ওপর এতগুলো ঋণ। আমার বাকি দিনডা চালাইবে কে?’

মিঠুনের স্ত্রী বিউটি দাস নির্বাক। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার শেষবার সে ফোনে বলল, চট্টগ্রামে আছে, কাজে ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। আর কথা হলো না।’