ডিএনএ প্রতিবেদনে আটকে আছে তদন্ত

শাহজাহান আকন্দ শুভ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ডিএনএ প্রতিবেদনে আটকে আছে তদন্ত

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা-ের মামলার তদন্ত ডিএনএ রিপোর্টের অপেক্ষায় আটকে আছে। এ প্রতিবেদন পেতে গত জুন মাসে কলকাতা পুলিশকে চিঠি দিয়েছিল সিআইডি পুলিশ। কিন্তু ডিএনএ প্রতিবেদন তারা পাঠায়নি। যে কারণে তদন্তও আর এগোচ্ছে না। এদিকে এখনও বিদেশে পলাতক আনোয়ারুল আজীম হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন।

মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু কলকাতায় খুন হওয়া ব্যক্তি যে আনার সেই জট খুলবে কলকাতা পুলিশের ডিএনএ প্রতিবেদনে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। যে কারণে ওই প্রতিবেদন চেয়ে সিআইডি পুলিশ আবার কলকাতা পুলিশকে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে এই চিঠি দেওয়া হবে।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল গত বছরের ১২ মে ভারতের কলকাতায় গিয়ে নিখোঁজ হন। পরের দিন ১৩ মে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিউটাউনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন। খুনের পর তার লাশ খ- খ- করে টয়লেটে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেন ঘাতকচক্র। পরে সেখানকার পুলিশ নিউটাউনের ফ্ল্যাটটির সেপটিক ট্যাংক ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটি খাল থেকে কয়েক টুকরা মাংস, হাড় উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া মাংশের টুকরা এবং হাড় আনারের কি না, তা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গত বছরের নভেম্বরে কলকাতায় গিয়ে ডিএনএ নমুনা দেন আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। পরে সেই নমুনা ভারতের সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়।

কলকাতার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আনোয়ারুল আজীম আনারের সঙ্গে তার মেয়ে ডরিনের ডিএনএ নমুনা মিলে গেছে। এতে প্রমাণিত হয় উদ্ধার করা মরদেহের খ-াংশগুলো সাবেক এমপি আনারের। কিন্তু এই ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত সিআইডি মামলাটির তদন্ত শেষ করতে পারছে না। দিতে পারছে না চার্জশিট।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক খান মো. এরফান আমাদের সময়কে বলেন, মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। আমরা ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষায় আছি।

আনোয়ারুল আজীম আনার নিখোঁজ ও হত্যাকা-ের বিষয়ে তাঁর মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন গত বছরের ২২ মে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। এ ছাড়া একই ঘটনায় ভারতেও একটি মামলা হয়। শেরেবাংলা নগর

থানার মামলাটিই এখন তদন্ত করছে সিআইডি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তকালে একসময়কার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভুইয়া, তাঁর ভাতিজা তানভীর ভুইয়া, সহযোগী শেলাস্তি রহমান, মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল আলী, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং একই কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার করে। এই সাতজনের মধ্যে সাইদুল করিম মিন্টু ছাড়া অপর ছয় আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দিতেই উঠে এসেছে এই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী হলো আনোয়ারুল আজীম আনারের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন। পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন সাইদুল করিম মিন্টুও। শাহীন ছাড়া বাকি সাতজন এখন কারাগারে। ভারতের কারাগারে আছেন খুনে অংশ নেওয়া জিহাদ হাওলাদার ও সিয়াম হোসেন। স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরেই আনারকে খুন করা হয় বলে তাঁদের জবানবন্দিতে তথ্য উঠে আসে।

একসময়কার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভুইয়ার জবানবন্দিতে উঠে আসে ঘাতকদের প্রথমে টার্গেট ছিল হানিট্রাপের মাধ্যমে আনারকে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে জিম্মি করে ১০-১২ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করা। মুক্তিপণ আদায় করতে না পারলে মেরে ফেলা। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা কীভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে, তারও পরিকল্পনা করা হয়। আনার ফ্ল্যাটে উঠেই সিয়াম ও জিহাদ তালুকদারকে দেখেই ডাক-চিৎকার করে ওঠেন। এ সময় ফ্ল্যাট থেকে বেরুনোর চেষ্টা করলে সিয়াম, জিহাদ, মোস্তাফিজসহ ফ্ল্যাটে আগে থেকে উপস্থিত ঘাতকদলের সদস্যদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। এ সময় ক্লোরোফর্ম দিয়ে আনারকে অচেতন করা হয়। কিন্তু ক্লোরোফর্মের মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়ায় আনার মারা যান। এর পরই তারা লাশ গুম করতে মরদেহ খ- খ- করেন। আর এসবই করা হয় আক্তারুজ্জামান শাহীন ও শিমুল ভুইয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী। আনারকে হানিট্রাপের মাধ্যমে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে জিম্মি করতে ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল ঘাতকদের সঙ্গে।

আনোয়ারুল আজীম আনার যে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন, আদালতে দেওয়া শিমুল ভুইয়ার জবানবন্দিতে সেই তথ্য উঠে এসেছে। স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে আনারের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের জেরেই আনারকে সড়কপথে ভারতে নেওয়া হয়। ১২ মে আনার কলকাতায় যান। ১৩ মে ওঠেন নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে। যে ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। আনারকে কীভাবে জিম্মি এবং হত্যা করতে হবে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব কিছু ঠিক করেই আক্তারুজ্জামান শাহীন ও শিমুল ভুইয়া কলকাতা ছাড়েন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, আনারের কারণে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ঝিনাইদহ-৪ আসনে বার বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন। আনার না থাকলে ভবিষ্যতে সংসদ সদস্য হতে তাঁর মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হতো। এই ভেবে মিন্টু আনার খুনে সায় দেন আক্তারুজ্জামান শাহীন ও শিমুল ভুইয়াকে। আনোয়ারুল খুনের ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে মোট ৯ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এর মধ্যে ভারতে দুজন, বাংলাদেশে সাতজন। আর হত্যাকা-ের মূল মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন পলাতক।

এদিকে ১৩ মে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে আনার খুন হওয়ার পর আক্তারুজ্জামান শাহীন ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে ভারতের নয়াদিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু যান। সেখান থেকে দুবাই হয়ে পালান যুক্তরাষ্ট্রে। ওই দেশে তাঁর নাগরিকত্ব রয়েছে। কিন্তু এখন শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন নাকি অন্যদেশে চলে গেছেন, তা তদন্ত কর্তৃপক্ষ জানে না। তাঁকে ধরতে ইন্টারপোলের শরণাপন্ন হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু সেটিরও কোনো অগ্রগতি নেই।

এদিকে মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে মামলার বাদী মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের বক্তব্য নিতে তাঁর সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। সিআইডিও তদন্তের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। কিন্তু ডরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আনার হত্যা মামলার তদন্ত অনেকটাই গতি হারিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। যে কারণে ডিএনএ প্রতিবেদন পেতে অপেক্ষা বাড়ছেই। তবে সিআইডি কর্মকর্তারা আশাবাদী, তারা শিগগরিই ওই প্রতিবেদন পাবেন।