হিজড়াকরণ চক্রের ভয়ংকর কাহিনি
হতাশাগ্রস্ত ও নিরীহ দরিদ্র যুবকদের দেওয়া হয় সচ্ছল জীবনের প্রলোভন। সেই প্রলোভনে পা দিলেই ফেলা হয় প্রতারণার ফাঁদে। তারপর কৌশলে হরমোন ইনজেকশন দিলে ধীরে ধীরে শরীর ও মনে পরিবর্তন আসে। এরপর চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালে নিয়ে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে চক্রে জড়িত চিকিৎসকরা। অপারেশনের পর ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের দিয়ে চাঁদাবাজি ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে। চক্রের সদস্যদের ইচ্ছামতো কাজ না করলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় ভুক্তভোগীকে। আর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার পর পরিবার ও সমাজে ফেরার কোনো উপায় থাকে না। ফলে নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগীরাও চক্রের একজন হয়ে ওঠেন। আমাদের সময়ের অনুসন্ধান ও পুলিশের মামলার তদন্ত থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকার ধামরাই থানার একটি মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় এক ভয়ংকর চক্রের হাতে প্রতারিত হয়ে অন্তত ৫০০ নিরীহ পুরুষ তাদের পুরুষাঙ্গ খুইয়েছেন। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ ও কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের ‘হিজড়া’ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এই চক্রে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও চিকিৎসক পরিচয়ধারী অন্তত চারজন সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু মামলার আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও ওই চিকিৎসকদের কাউকেই এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঢাকার ধামরাই থানার একটি মামলার তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ফুলতলার হাদিউজ্জামান ও তার চক্রের সদস্যরা সহজ-সরল পুরুষদের প্রথমে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। অর্থের লোভে ফেলে হরমোন ইনজেকশন দেয়। হরমোন ইনজেশনের ফলে তাদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব স্পষ্ট হয়। চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করে যৌনাঙ্গ কেটে ফেলে দেয়। চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালগুলোর মধ্যে ধামরাই থানার রোম-আমেরিকান ছিল অন্যতম।
ধামরাই থানার আরেকটি মামলার তদন্ত শেষে চলতি বছর ৯ জুলাই ঢাকার আদালতে চার্জশিট দেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা জেলার উপ-পরিদর্শক মনজুর রহমান। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন- প্রলুব্ধ করে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানোর জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় শক্তিশালী চক্র কাজ করে। তারা হতাশাগ্রস্ত যুবক এবং হিজড়াদের প্রতি আসক্তদের ফাঁদে ফেলে। সচ্ছল আর নির্ভার জীবনের কথা বলে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানায়। একবার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে স্বাভাবিক জীবনে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। সমাজ ও পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর চক্রের হোতাদের কথামতো চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
মামলার তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, চক্রের হোতা হাদিউজ্জামান এবং ইহাদ লস্করের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ডা. মহসীন, ডা. সামছুদ্দিন, ডা. গৌরাঙ্গ, ডা. মোর্শেদ, ডা. জিতেন্দ্রনাথ এবং ডা. রাজিবদের নাম এসেছে। তাদের সম্পূর্ণ নাম-ঠিকানা সংগ্রহের চেষ্টা করি। তবে তা সম্ভব হয়নি। আর গ্রেপ্তার করলেও হাদিউজ্জামান জামিন পেয়েছেন। এখন হাদিউজ্জামানের অবস্থান তিনি জানেন না।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আদালতে হাদিউজ্জামানের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, খুলনা জেলার ফুলতলায় হাদিউজ্জামান এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। দ্রুত ধনী হওয়ার পরিকল্পনায় সহজ-সরল নিরীহ মানুষকে প্রলোভনে ফেলে পুরুষাঙ্গ কেটে ‘হিজড়াকরণ’ চক্রে জড়িয়ে পড়েন। খুলনায় ‘ফুলতলা সার্জিকেল’ নামে একটি ক্লিনিক দেন। বিপুল অংকের টাকার চুক্তিতে তার সঙ্গে যুক্ত হন ডা. গৌরাঙ্গ, ডা. মোর্শেদ, ডা. জিতেন্দ্রনাথ। হাদিউজ্জামানের চক্রটি প্রায় এক যুগে ৪০০ থেকে ৫০০ জনের পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানিয়েছে। ২০০ থেকে ২৫০ জনকে সারকি (ইমপ্ল্যান্ট) করেছেন।
দেলু নামে এক হিজড়া জানিয়েছেন, প্রলোভনে পড়ে তিনি চক্রে জড়িয়ে পড়েন। হাদিউজ্জামানের ক্লিনিকেই কাজ করেছেন। প্রায় ৮-৯ বছর আগে জামালপুর থেকে তিনজনকে কৌশলে খুলনায় নিয়ে যান। এরপর হাদিউজ্জামান তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানিয়ে দেন।
ধামরাই থানায় ২০২৩ সালের একটি মামলার সম্প্রতি দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, হাদিউজ্জামান ছাড়াও হিজড়াকরণ চক্রে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। এর মধ্যে মিরপুর যুক্তবাংলা মার্কেট এলাকার ডা. রাজিব। তিনি সিএসএ লেজারের মাধ্যমে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া করেন। যশোরে বসুন্দিয়া বাজারে ইহাল, খুলনার রূপসার আমানুল্লা ক্লিনিকের মালিক ডা. আমান উল্লাহ, বাগেরহাটের চিতলমারীতে চিতলমারী ক্লিনিকে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া করা হয়। যশোর জেলার মনিরামপুরে বেসি ক্লিনিকে ডা. প্রশান্ত ও মহসিন এ ধরনের অপারেশন করেন। তা ছাড়া ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় বাসায় নিয়ে অপারেশন করে পুরুষাঙ্গ কাটা হয়। ডা. সামসুদ্দিন ঢাকার ডেলটা হাসপাতালে এই কাজ করেন।
ঢাকার আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে প্রায় এক যুগ ঢাকার ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডে রোম-আমেরিকান হাসপাতালে প্রতারণার মাধ্যমে পুরুষদের যৌনাঙ্গে অস্ত্রোপচার ও হরমোন ইনজেকশন দিয়ে হিজড়ায় পরিবর্তন করা হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
হিজড়াকরণ চক্রে জড়িত থাকা মাগুরার ইহাদ লস্কর নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে লস্কর জানান, তিনি ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেছেন। মাগুরার শালিখার বসুন্দিয়া বাজারে রহমত মেডিক্যাল হল নামে তার একটি ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির আড়ালে তিনি মূলত পুরুষদের অপারেশনের মাধ্যমে হিজড়ায় রূপান্তর করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, খুলনার ফুলতলার হাদিউজ্জামানের কাছে প্রায় ৫-৭ বছর আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হিজড়ায় রূপান্তর করা শেখেন। এরপর তিনি নিজেই ফার্মেসি দিয়ে তার আড়ালে ১৫০ থেকে ২০০ জনের মতো পুরুষকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হিজড়ায় রূপান্তর করেন। প্রতিটি অপারেশনে তিনি চক্রের কাছ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা পেতেন।
বরিশালের বাউনিয়ার রিপা নামে একজন হিজড়া জানান, ২০১৪ সালের দিকে ধামরাই রোম-আমেরিকান হাসপাতাল থেকে দেলু হিজড়ার মাধ্যমে হাদিউজ্জামানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর হাদিউজ্জামান তার পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানান।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরুষদের প্রলোভনে ফেলে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো নৃশংস অপরাধ। এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তির আওতায় না আনলে সমাজে ভয়াবহ বার্তা যাবে। একই সঙ্গে অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
পুলিশ বলছে, সংসারে অভাব-অনাটনে আছে এমন যুবকদের টার্গেট করে চক্রটি। এই চক্রের খপ্পরে পড়ে এক সন্তানের জনক নওশাদ হিজড়া হয়েছিলেন। পরে হতাশাগ্রস্ত সেই হিজড়া হত্যাকা-ে জড়িয়ে পড়েন। জানা যায়, এক যুগ আগে স্ত্রী মারা যাওয়া নওশাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দেলু হিজড়ার। নওশাদকে দেলু প্রলোভন দেখিয়ে বলেন, হিজড়া হলে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। পরে নওশাদ অপারেশন করে ছেলে থেকে মেয়ে হিজড়ায় পরিণত হন। নতুন নাম হয় চম্পা। দেলুর অধীনে কাজ করেন অন্তত পাঁচ বছর। এরপর রাকিব হাসান শাওন নামে এক যুবকের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজন বসবাস শুরু করেন। পরে রাকিবের সঙ্গে অন্য হিজড়ার সম্পর্ক রয়েছে এমন সন্দেহে ২০২১ সালের ১ জুন রাকিবকে খুন করে চম্পা লাপাত্তা হয়ে যান।
হাসপাতালের পাশাপাশি বিউটি পার্লারের আড়ালেও এসব অবৈধ চক্র সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, রাশেদ আহম্মেদ নাসিম নামে এক ব্যক্তি ঢাকার নিকেতন এলাকায় আয়ান এইচএস লেজার অ্যান্ড বিউটি পার্লার খুলে দালালের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরুষদের এনে হিজড়া বানিয়েছেন। এই হিজড়ারা পতিতাবৃত্তি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চাঁদাবাজি ও প্রবাসীদের মারধরের অভিযোগে ১২ জন হিজড়া এবং গতকাল মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।