রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বাড়ছে মবের শঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে মব তৈরি করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ রাজনৈতিক নেতাদের লাঞ্ছিতের সঙ্গে জড়িত জাহিদ হাসানের শরীয়তপুরের বাড়িতে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর আক্রমণ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রতিশোধে মাঠ পর্যায়ে মবকে উসকে দিতে পারে। তবে মব দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হবে এবং নির্বাচনের আগেই শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাস থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত ১৩ মাসে মব সহিংসতায় দেশে অন্তত ২২০ জন নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বলছে, এ বছর মার্চ থেকে আগস্ট- এই ছয় মাসে মব সহিংসতা হয়েছে ২৩০টি। এতে নিহত হয়েছেন ৭৯ জন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন ২৬৫ জন। ভয়েস ফর রিফর্ম এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সমীক্ষা বলছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সন্ত্রাস নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা থেকে মব তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, মব সন্ত্রাসে যারা ইন্ধন দিচ্ছে এবং যারা সুবিধাভোগী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে যারা মব করছে এবং করতে চায়, তাদের মধ্যে মব করার মানসিকতা কাজ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিকল্প নেই।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানের মব অধিকাংশ মূলত পরিকল্পিত। জনতাকে উসকে দেয়, যাতে হত্যার দায় স্পষ্টভাবে কারও ওপর না পড়ে। এতে একদিকে প্রতিপক্ষকে দমানো যায়, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে মূল হোতারা দায় এড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ব্যক্তিগত বিরোধের জেরেও নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে দুর্বৃত্তরা।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে সরকারের উপদেষ্টাদের অনলাইনে-অফলাইনে টার্গেট করা হচ্ছে। আক্রান্ত নেতাদের সহকর্মী ও রাজনীতিকরা বলছেন, এ ধরনের আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারকে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকজন নেতা।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিম গত মঙ্গলবার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন- যেখানে আওয়ামী লীগ, সেখানেই মাইর আজ থেকে। জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স (জেআরএ) ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে- লীগের ওপর সকল ধরনের মব, সকল জায়গাতে জায়েজ হলো।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন- আইন আদালতকে পাশ কাটিয়ে মব সন্ত্রাস বা আইন নিজের হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রমনা মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে, কারণ এই অসভ্যতা চলতে পারে না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
শীর্ষ একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মব প্রতিরোধের ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষ করে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের আগেই সব ধরনের মব সন্ত্রাস শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে চায় সরকার। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও সামরিক বাহিনীকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাহিনীগুলো জোরালো পদক্ষেপ নেবে।
মব সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন- মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকা-ের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে প্রতিহিংসা ও ক্ষোভকে উসকে দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করছে বিভিন্ন চক্র। গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন।
আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইফুল হক সাইফ বলেন, মব সৃষ্টির মূল কারণ যদি খুঁজে বের করা যায়, তাহলে থামানো সম্ভব। আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে মব সৃষ্টির প্রবণতা কমে যাবে।