জাতিসংঘে ব্যস্ত দিন পার ড. ইউনূসের /

পাচারের অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা কামনা

আরিফুজ্জামান মামুন নিউইয়র্ক থেকে
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পাচারের অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা কামনা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই ব্যক্তিত্ব বলেন- উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন সংক্রান্ত চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো এখন কার্যকর কর্মপরিকল্পনায় রূপান্তর করতে হবে। এসডিজি অর্জনে বার্ষিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের

বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করা দুরূহ হলেও এটি অপরিহার্য। তিনি বলেন, আসুন আমরা মর্যাদা, যৌথ সমৃদ্ধি ও স্থিতিস্থাপকতার এক অর্থনীতি গড়ে তুলি যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।

জাতিসংঘে গতকাল ‘টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য প্রথম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি’র উদ্বোধনী পর্বে দেওয়া ভাষণে তিনি এমন আহ্বান জানান।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের অবশ্যই সেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনা উচিত, যারা আমাদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি, দারিদ্র্য কখনও কারও স্বপ্নপূরণের অন্তরায় হতে পারে না। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং সম্পদে প্রবেশাধিকার হলো ন্যায়বিচারের হাতিয়ার। তিনি উল্লেখ করেন, সেভিল প্রতিশ্রুতি একটি নতুন কাঠামো প্রদান করেছে, যা শক্তিশালী দেশীয় সম্পদ আহরণ, অবৈধ অর্থপ্রবাহ মোকাবিলা, উন্নয়ন ব্যাংকসমূহকে ক্ষমতায়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

এসডিজি বাস্তবায়নে অর্থায়ন উন্নত করার পাঁচটি অগ্রাধিকার তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন- প্রথমত, দেশীয় সম্পদকে ন্যায্যভাবে আহরণ করতে হবে এবং এতে আন্তর্জাতিক সহায়তা যুক্ত হতে হবে। করব্যবস্থা হতে হবে প্রগতিশীল ও স্বচ্ছ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তাদের ন্যায্য অংশ প্রদান করতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, জাতিসংঘের বাজেট হ্রাস বা উন্নয়ন সহায়তা সংকুচিত হলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেখানে একদিকে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত এবং অন্যদিকে জলবায়ু দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা চলছে। তাই বৈশ্বিক সহায়তা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, উদ্ভাবনী অর্থায়ন ও সামাজিক ব্যবসাকে কাজে লাগাতে হবে। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক আর্থিক স্থাপত্য ও ঋণ শাসনব্যবস্থা সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। চতুর্থত, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অবৈধ অর্থপ্রবাহ প্রতিরোধ এবং নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। পঞ্চমত, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

চুরি যাওয়া ডলার পুনরুদ্ধারে বিশ^ব্যাংকের সহযোগিতা কামনা

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলমান ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। দিনব্যাপী এসব বৈঠকে তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, গণতান্ত্রিক রূপান্তর, স্বাস্থ্য খাত এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ে আলোচনা করেন। মঙ্গলবার দিনের শুরুতে প্রফেসর ইউনূস বৈঠক করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গার সঙ্গে। এ সময় দেশের চুরি হয়ে যাওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সভাপতি বঙ্গার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

বৈঠকে তাঁরা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে- আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন, দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, রাজস্ব ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, চট্টগ্রাম বন্দরের পুনরুজ্জীবন, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একীকরণ এবং এশিয়াজুড়ে তরুণদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা।

এ সময় অজয় বাঙ্গা গত ১৪ মাসে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বব্যাংকের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এ সহায়তা ছিল অমূল্য।

বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এসডিজিবিষয়ক সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

এরপর প্রফেসর ইউনূস বৈঠক করেন প্যারিসের মেয়র অ্যানে হিদালগোর সঙ্গে। আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম, ক্রীড়া ও অলিম্পিকে সামাজিক ব্যবসার সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক মানবিক সংকট, বিশেষত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা। প্রফেসর ইউনূস বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসসহ ভবিষ্যতের অলিম্পিকগুলোকে কার্বন নিরপেক্ষ করার ওপর জোর দেন। মেয়র হিদালগো এ সময়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। বৈঠক শেষে প্রফেসর ইউনূস তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বৈঠক করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদরস আধানোম গেব্রিয়াসিস, চিলির প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান এবং উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এসব বৈঠকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারপ্রক্রিয়া, ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে মতবিনিময় করেন।