ভোক্তার কাঁধে বাড়তি বোঝা
বাজারে আগে থেকেই চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস ও তরিতরকারির ঊর্ধ্বমূল্যে ভোক্তারা বিপাকে। এর মধ্যে নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর দাবি তুললেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কম হারে সমন্বয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও ঠিক কত টাকা বাড়ানো হবে- এ ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দাম বাড়ছে এটা একরকম নিশ্চিত। অর্থাৎ প্রতিদিনের রান্নায় দরকারি ভোজ্যতেলের পেছনে গৃহস্থের বাড়তি খরচ আরও বাড়তে চলেছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বিপণনকারীদের সংগঠন- বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সয়াবিন ও পাম উভয় তেলের দামই লিটারে ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশি বাজারেও বাড়াতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সঙ্গে গত রবিবার বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার পরিশোধন কারখানার মালিক ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করে মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মূল্যবৃদ্ধিসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কিছু জানানো হয়নি।
তবে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান গত সোমবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কারখানার মালিকরা দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। এটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দাম বাড়তে পারে ঠিক, তবে লিটারে কত টাকা বাড়বে, সেটা হিসাব করা হচ্ছে।
এদিকে ভোজ্যতেলের মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যে প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ান কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয় তা কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা দেখি ব্যবসায়ীরা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিলে বৈঠক করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঠিক কোন পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ করেন সেটা পরিষ্কার নয়। মূল্য সমন্বয়ের বৈঠকে ভোক্তাদের প্রতিনিধি রাখা হয় না। এ নিয়ে ক্যাবের পক্ষ থেকে বহুবার; এমনকি লিখিতভাবে জানানো হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের যে তথ্যের ভিত্তিতে ট্যারিফ কমিশন পর্যালোচনা করে সেটাও কতটা সঠিক প্রশ্ন রয়েছে। আবার ব্যবসায়ীরাও যেভাবে দাম বাড়ান সেটাও তো সঠিক নয়। তারা (ব্যবসায়ীরা) ট্যারিফ কমিশনে প্রস্তাব না করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে করে। অনেক সময় প্রস্তাব না করে সরাসরি দাম বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে পাই, ব্যবসায়ীরা চাপ দিলেই দাম বাড়ানো হয়। বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীরা যত দ্রুত দেশীয় বাজারে বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, কমার বেলায় তাদের ততটা গরজ দেখা যায় না। আবার দাম বাড়ালে রাতারাতি বাজারে বেড়ে যায়, কিন্তু কমানো হলে তা আবার কার্যকর হয় না। এ নিয়ে আমরা হতাশ। বিশ্ব বাজারে কয়েক মাস আগে দাম বেড়েছে ঠিক। কিন্তু তার আগে তো নিম্নমুখী ছিল, তখন তো তারা (ব্যবসায়ীরা) দাম কমাননি।
নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, আগের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের বাজার নিম্নমুখী ছিল। সেখানে পরবর্তী এপ্রিল-জুন; এমনকি গত জুলাই মাসেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। তবে গত আগস্টে সয়াবিন তেলের বাজার আবার নিম্নমুখী রয়েছে। জুলাইয়ে বিশ্ব বাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ১ হাজার ৩০৭ ডলার ছিল। যা আগস্টে ১ হাজার ২৪৫ ডলারে নেমেছে।
দাম বাড়ানোর বিষয়ে ভোজ্যতেল সরবরাহকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এদিকে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর খুচরা বাজারে সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতল ১৮৮ থেকে ১৯০ টাকা পর্যন্ত এবং খোলা তেলের লিটার ১৭০ থেকে ১৭৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বছরের ব্যবধানে বোতলজাত সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ এবং খোলা তেলে এ হার প্রায় ১৬ শতাংশ। অপরদিকে একই সময়ে পাম তেলের মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা নতুন করে দাম বাড়ালে ভোজ্যতেলের পেছনে ভোক্তার এ বাড়তি খরচ আরও বাড়বে। যা নিয়ে ইতোমধ্যেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী এনামুল হক বলেন, প্রতিদিনের রান্নায় খাওয়ার তেল প্রয়োজন। এটা ছাড়া তো আর রান্না হবে না। আর এটার পেছনেই খরচ লাগাতার বাড়ছে। যতটা বাড়ে ততটা কমে না। খবরে জেনেছি এখন আবার বাড়ানো হচ্ছে। এটা হলে সংসারের বাজার খরচের চাপ অনেকটা বেড়ে যাবে। আমাদের পক্ষেই সামাল দেওয়া কঠিন, সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কোথায় যাবে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত ১২ আগস্ট দেশের বাজারে পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আগে যা ছিল ১৬৯ টাকা। তবে সে সময় সয়াবিন তেলের দাম অপরিবর্তিত (১৮৯ টাকা) রাখা হয়। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় প্রতি লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে সয়াবিন তেলের দাম ১৮৯ টাকা করা হয়। তার আগে যা ছিল ১৭৫ টাকা।
এদিকে আগে সরকার সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, পাম ও ভুট্টার তেল আমদানিতে অগ্রিম কর ও ভ্যাট থেকে ছাড় থাকলেও গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার বীজ ও তেল, পাম তেল এবং ভুট্টার তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে।