সাংবিধানিক সংস্কারের সমাধান আদালতে?
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে বিপরীতমুখী অবস্থান। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে ভিন্ন ভিন্ন মতে অটুট দলগুলো। এ অবস্থায় সমাধান খুঁজতে ফের আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে কমিশন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নেওয়া যেতে পারে। ঐকমত্য কমিশনও সেই পরামর্শ গ্রহণ করে আগামী মাসের শুরুতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের জন্য প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে- জুলাই সনদের সমাধান কি তাহলে আদালতে?
এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরা আবার বসব। তখন ওনাদের চূড়ান্ত পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, রাষ্ট্রের ইতিহাসে আমরা যেন নতুন করে অবদান রাখার চেষ্টা করছি। বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশ বলে সংবিধানে কিছু নেই। এখন উনারা যদি ইয়াহিয়া খানকে ফলো করে একটা কিছু করতে চান, তাহলে করতে পারেন। সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্স, কোর্ট যে মতামত দেবে, সেটি তো রায় না- একটা পরামর্শ। সুপ্রিমকোর্ট নিজে সেই পরামর্শ মানতে বাধ্য নয়। সুপ্রিমকোর্টের রায় মানতে বাধ্য কিন্তু এটা তো রায় না। অতএব এটা মানতে আইনগতভাবে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে, কেউ মানতে বাধ্য নয়।
সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চাওয়ার বিষয়ে শাহদীন মালিক বলেন, এই আইনটা সাংবিধানিক কি সাংবিধানিক না, এ পরামর্শ সুপ্রিমকোর্টের মতামতের জন্য জানতে চাওয়া যায় না। এখন যা শুনছি সব নতুন, যা আগে কখনও শুনিনি। এ বিষয়ে আর কিছু বলার নেই।
সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ার বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ উল্লেখ রয়েছে- যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত ২০ সেপ্টেম্বর আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় অংশ নেন।
এদিকে সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফার বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ জারি করতে পারে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এরপর আদেশটি নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা যেতে পারে। তবে এ প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি।
বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে সাংবিধানিক সংস্কার করার আইনি সুযোগ নেই। কেননা, পরে আইনি চ্যালেঞ্জ করলে এই সাংবিধানিক আদেশের সংস্কার আদালতে টিকবে না। এরপরও কমিশন চাইলে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে যেভাবে এই সরকার গঠন করা হয়েছে, তেমনি সাংবিধানিক আদেশে সংস্কারের বিষয়ে মতামত নিতে পারে। অন্যদিকে জামায়াতের দাবি, সাংবিধানিক আদেশের মৌলিক সংস্কার এবং সেই আলোকে সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সাংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচন দাবি করে আসছে। বিশেষ আদেশে সাংবিধানিক সংস্কারে বাদ দলগুলোরও আপত্তি রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২০ সেপ্টেম্বর ফের আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। বৈঠকে কমিশন উপস্থাপিত সনদের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সম্ভাব্য সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পূর্বে অনুষ্ঠিত আলোচনার সারসংক্ষেপ বিশেষজ্ঞদের অবহিত করে। আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত, পরামর্শ এবং উদ্বেগসমূহ বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়, যাতে বিশেষজ্ঞরা সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারেন। পরে সনদের বাস্তবায়নের উপায় ও কৌশল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও পরামর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে তা বিবেচনায় আনা হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রথমে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকেও ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার বিষয়টি এসেছিল। পরে বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়। এখন আবার একটি বড় দলের পক্ষ থেকে একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আবার মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশন সংশ্লিষ্ট একজন আমাদের সময়কে বলেন, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া হবে। সেই আলোকে সাংবিধানিক বিশেষ আদেশে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে। সেই সংস্কার অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট হবে- এমন পরামর্শ দিয়েছে আইন বিশেষজ্ঞরা। ঐকমত্য কমিশন এই পরামর্শ অনুযায়ী আগামী মাসের শুরুতে পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর তার দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে। আগামী মাসের শুরুতে দলগুলোর সঙ্গে ফের বৈঠক করবে কমিশন। আগামী ১৫ অক্টোবর শেষ হচ্ছে কমিশনের দ্বিতীয় দফায় বর্ধিত মেয়াদ।