সবাই হাসিমুখে কথা বলে, এটাই আমার জীবনে বড় পাওয়া
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ‘ভাবের তরী’র গাওয়া ‘মনমাঝি খবরদার’ গানটি। ‘মনমাঝি খবরদার, আমার তরী যেন ভেড়ে না, আমার নৌকা যেন ডুবে না...।’ এই গান এখন সবার মুখে মুখে। ফেসবুক, টিকটক, রিলসসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সয়লাব তাদের গাওয়া এই গানটি। ‘মনমাঝি খবরদার’ গানটি তৈরির গল্প ও ‘ভাবের তরী’র পথচলা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় ‘ভাবের তরী’র গায়ক মো. আল-আমিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তারেক আনন্দ
‘ভাবের তরী’র শুরুর গল্পটা জানতে চাই। ঠিক কত বছর আগে, কীভাবে আপনাদের গান গাওয়া শুরু হলো?
‘ভাবের তরী’র শুরু আমার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু হতাশার গল্প নিয়ে। আমার বাসা শেরপুর জেলা সদরের নবীনগর গ্রামে। এখানে সংগীতচর্চাকে সবাই অন্যভাবে নিত। মিউজিক করার কোনো পরিবেশ ছিল না। কেউ মিউজিক করলে মানুষ খারাপ চোখে দেখত। আমার বাবা ছোট্ট একটা সরকারি চাকরি করতেন। বাবাকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি প্রচুর গান শুনতেন। বিভিন্ন শিল্পীর গান। আব্দুল আলীম, রাধারমন, লালনসহ কাওয়ালি, উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতেন। আব্বা শুনতেন, পাশাপাশি দোতরা বাজাইতেন। আমার আব্বার নাম হযরত আলী। আব্বা দশ বছর আগে মারা গেছেন। আব্বার কাছেই দোতরা বাজানো শিখি। গানবাজনা ভালো লাগত। পরে ব্যান্ড মিউজিক ভালো লাগে। গান বানানো, কম্পোজিশনের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে। ‘কালচক্র’ নামে একটি অ্যালবামের কাজ শুরু করি ২০১৮ সালে। স্টুডিও, স্টুডিওতে ঘুরেছি, কারোর কোনো রেফারেন্স ছিল না। চব্বিশে এসে কাজ শেষ হয়েছে। এখনও রিলিজ করতে পারিনি। আমার কাছে এটা রিলিজ করার মতো টাকা-পয়সা নেই। ২০২৫ সালের জানুয়ারির আগে তিন-চার মাস ব্যাপক হতাশায় ছিলাম। আর ভাবলাম, সংগীতজীবনে এত সময় দিলাম। কিছুই তো হচ্ছে না। আমি ছাত্র হিসেবে খুব বেশি ভালো ছিলাম না। গানবাজনা করার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারিনি। টানা আট-দশ বছর গান নিয়েই ছিলাম।
মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন। হতাশা দূর হলো কীভাবে?
‘ভাবের তরী’ কীভাবে হলো এটা বলছি। গানবাজনার পেছনে আট-দশ বছর সময় দেওয়ার পর যখন কিছুই হচ্ছিল না, এক সময় মনে হচ্ছিল, আমার বন্ধু-বান্ধব ওরাও ক্যাম্পাসে চলে গেছে। কেউ চাকরি করছে। আমার জীবন কোনদিকে যাবে? গান দিয়ে কি মানুষের সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে পারব? এখন কী করা যায়, কী দিয়ে শুরু করতে পারি? একদিন ঘুরতে ঘুরতে গেলাম আমাদের এখানে একটা নদী আছে। মৃগী নদী। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী হবে। এখানে একটা ঘাটপাড় আছে। সেদিন আমার খুব কষ্ট লাগছিল। একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ঘাটপাড়ে। চোখ বেয়ে টলমলিয়ে পানি পড়ছিল। সঙ্গে কেউ ছিল না। আমি একা, ঘাটপাড় আর নদী। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি, কিনারায় একটা ভাঙা নৌকা পড়ে আছে। দেখে মনে হলো, আমার আর নৌকার সঙ্গে হুবহু মিল। এই নৌকাটা আমি কি দিয়ে বেয়ে নিয়ে যাব? ভাব দিয়ে যদি না বাইতে পারি তাহলে তো সম্ভব নয়। ভাব দিয়েই বেয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখান থেকেই আমার ‘ভাবের তরী’ নামটা এলো। সেদিন নৌকার ছবিও তুলে রেখেছিলাম। ‘ভাবের তরী’ করার দু-এক মাস আগের ঘটনা এটি। তখন চিন্তা করে দেখলাম যে, আমার বাবাও ফোক সংগীত করত। আমিও ফোক দিয়েই শুরু করি। আমার কাছে গান শিখতে আসা কিছু স্টুডেন্ট ছিল। কেউ দোতরা শিখত, কেউ ইউকেলে। ওদের একদিন ডাক দিই। সবাইকে বলি, আমাকে সময় দাও। আমি কিছু একটা করতে চাই। তোমরা আমার কাজে সহায়তা করো। আমি কিছু একটা করতে চাই মিউজিক নিয়ে। ওরা আমাকে সাহস দিল। ভাই আপনার সঙ্গে আছি। ‘ভাবের তরী’ নাম দিয়ে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খুলি। পেজের ক্যাপশন দিই ‘সাধু সঙ্গ প্রেম তরঙ্গে ভাবের তরী বাইয়া যাই।’
ব্যান্ডের সদস্য কয়জন? ‘ভাবের তরী’ কারা বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
আমাদের ব্যান্ডের সদস্য নয়জন। পর্দার সামনে আছি পাঁচজন। মো. আল-আমিন (ভোকাল+লিড), ফরহাদ হোসেন (ডুগি), আবির হাসান (পারকাসন), ইসমাইল হোসেন (গিটার), প্রণয় সরকার (কাজন)। এবং রাসেল (ডিজাইনার), মনির (সদস্য), জয় (সদস্য) ও জিসান (সদস্য)।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
শুরুতে কোন গানগুলো করছিলেন?
আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল এ রকম, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে কিছু গান আছে, যেগুলো নতুন করে গাইলেই মানুষ খুব পছন্দ করবে। গানগুলা তুলে আনছে না কেউ। আমার স্টুডেন্টদের বললাম, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করো। আমরা কাজ করতে থাকি। ফিডব্যাকের আশা চিন্তাও করব না। শাহ আব্দুল করিমের কিছু গান করলাম। পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও কিছু মৌলিক কাজ আছে। এগুলো করব। কভারগানগুলো রিলিজ দেওয়ার পর দেখি মানুষের সাড়া পাচ্ছি। পবন দাস বাউলের ‘চঞ্চলও মন আমার শোনে না কথা’ কাভার করলাম। এটার মোটামুটি ভালো রেসপন্স ছিল। এরপর চিন্তু করলাম...।
‘মনমাঝি খবরদার’ গানের সন্ধান কীভাবে কোথা থেকে পেলেন?
‘মনমাঝি খবরদার’ গানটা আমার বাবা শুনত, গাইত। বাবার স্মৃতির গানটি গাওয়ার চিন্তা করি। আর গানটা আমাদের ‘ভাবের তরী’র ভাবনার সঙ্গেও যায়। এই গানটা গাইলে আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। গানটি আব্বাকে উৎসর্গ করে গাইলাম।
কতদিন পর গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল? কেমন সাড়া, মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন?
এক কথায় অকল্পনীয়। গানটি প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই দেখি মিলিয়ন ভিউ। এক মাসেই দুই কোটি ছাড়িয়ে গেল। এখন প্রায় তিন কোটি ভিউ। নিজের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করল। আমার ছাত্ররা খুব খুশি।
আরও পড়ুন:
ফের জুটি হলেন মম-শ্যামল
এই গানের মাধ্যমে আলামিনের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন ভাবতে কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে। মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি। তবে আমি ব্যক্তিজীবনে আগের মতোই আছি। যেভাবে চলতাম, খাইতাম, ঘোরাঘুরি করতাম, হুবহু ওভাবেই আছি। কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন নেই। সবার ভালোবাসা পাই, সবাই হাসিমুখে কথা বলে এটা আমার জীবনে বড় পাওয়া।
বলছিলেন, মৌলিক গানের কাজ করে রেখেছেন। মৌলিক গান নিয়ে এখন কী ভাবছেন?
আগামী মাসেই একটা মৌলিক গান প্রকাশ করব। ‘ভাবের তরী’র থিম ধরে একটা গান লিখেছিলাম। গানটা এ রকম ‘আন্ধার রাইতে তোমার কথা আমার মনে পড়ে, তুমি কই লুকাইলা আমায় থুইয়া একলা ঘরে...।’ এই গানটি প্রকাশের চিন্তা করছি।
আপনার লেখা কতগুলো গান আছে?
আমার লেখা তিরিশটির মতো গান আছে। এগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করব। ফোক দিয়ে শরু করার কারণ হলো, মৌলিক গান দিয়ে আমি সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছিলাম না। আমার কাছে টাকা-পয়সার সংকট ছিল। খুব বেশি ধনী পরিবার না আমরা। এমন ফ্যামিলি থেকে কাজ করা খুব কঠিন। টাকা-পয়সা তেমন একটা নেই। আব্বা-আম্মা দুজনই মারা গেছেন। এর মধ্যে আমি বিবাহিত। আমার ফ্যামিলিও চালাতে হয়। মৌলিক গান করার জন্য এক সময় আমার পৈতৃক ভিটেমাটিও বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন:
মারা গেলেন পরীমনির নানা
সামনের পরিকল্পনা কী? কীভাবে আগামী দিনে পথ চলতে চান?
যেটা নিয়ে আমি স্ট্রাগল করেছি, কষ্ট করেছি অনেক। এখন আমার ইচ্ছে হলো, বিভিন্ন অঞ্চলে যারা অখ্যাত সংগীতশিল্পী আছেন, নিজের মতো করে চর্চা করে যাচ্ছেন, অবহেলিত। আমাদের শেরপুরেও অনেক আছে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। যেমন আমাদের শেরপুরেও এমন শিল্পী আছে। এগুলো কিন্তু সরকারিভাবে হওয়া উচিত। যেমন,
আমাদের শেরপুরে শিল্পকলা আছে। এদের কোনো খোঁজখবর রাখে না, খুবই কষ্টের বিষয়। তাদের উচিত আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা।