৮৮৬ কর্মীর বর্ধিত বেতনে বেবিচকের আজব শর্ত
নিয়োগের প্রায় চার বছর পার হলেও নানা জটিলতায় ৮৮৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এখনও স্থায়ী করতে পারেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তাদের বেতন বৃদ্ধি ও ভাতাও আটকে রয়েছে। তবে ৩০৬তম বোর্ড সভায় এসব কর্মীর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু বর্ধিত এ বেতন তুলতে আজব এক শর্ত জুড়ে দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষটি। শর্ত অনুযায়ী, ভবিষ্যতে কোনো কারণে অডিট আপত্তি উঠলে এসব কর্মীর বর্ধিত বেতনের পুরো অর্থ ফেরত দিতে হবে। এই শর্ত মেনে মুচলেকাও দিতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, জনপ্রশাসন প্রবিধানমালার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এই কারণে মুচলেকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এই শর্তে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
জানা গেছে, গত ৩০ জুন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৩০৬তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৮৮৬ কর্মীর বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আড়াই মাস পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করতে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠায় বেবিচকের প্রশাসন বিভাগ।
বেবিচকের প্রশাসন বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবিদুল ইসলামের সই করা চিঠিতে বলা হয়, বোর্ড সভার ২-এর ক নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেবিচকের নবসৃষ্ট পদসমূহে যোগদানকারীদের মধ্যে ২ বছর অতিক্রান্ত হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শর্তসাপেক্ষে বার্ষিক বেতন বর্ধনের বিষয়ে বোর্ড কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভবিষ্যতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো অডিট আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত প্রদান করতে হবে মর্মে তাদের নিকট হতে লিখিত (মুচলেকা) গ্রহণ করতে হবে। চিঠিতে এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্রে জানা গেছে, বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ওই কর্মীদের বেতন বাড়াতে সম্মত হলেও এতে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ভবিষ্যতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির কারণে কোনো কর্মকর্তা বা অডিট কর্তৃপক্ষ আপত্তি উত্থাপন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত দিতে হবে। এ জন্য তাদের কাছ থেকে আগেই লিখিত (মুচলেকা) নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, বেতন বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রবিধান শিথিলের বিষয়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব পাঠানো হবে। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধান অনুসারে প্রদত্ত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচক চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর ১১ (৩) ধারা শিথিল করার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বেবিচক কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কারণে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধানমালার আলোকে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যা পরে বেবিচকের চাকরি প্রবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বেতন বৃদ্ধি কার্যকর করতে গেলেই অডিট আপত্তি আসতে পারে।
বেবিচকের চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, নবনিযুক্তদের শিক্ষানবিশকাল দুই বছর। এ সময় তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নেই। ফলে প্রবিধান অনুযায়ী, শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার পর তাদের চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা এবং স্বাভাবিক নিয়মে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রবিধানমালার বেশ কয়েকটি ধারা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
প্রবিধানের ধারা ৮ অনুযায়ী, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকার যেভাবে নির্ধারণ করবে সেভাবেই দেওয়া হবে। আবার জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ধারা ১০ (১)-এ বলা আছে; সকল কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির তারিখ হবে প্রতিবছর ১ জুলাই। নতুন যোগদানকারী কর্মচারী যদি ন্যূনতম ৬ মাস চাকরি করেন তবে তিনি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। অথচ চাকরি প্রবিধানমালা ২০২১-এর ধারা ৬ (৫) বলছে, অস্থায়ীভাবে সৃষ্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি শিক্ষানবিশ হিসেবে গণ্য হবেন না। তবে অস্থায়ী পদ যেদিন স্থায়ী হবে, সেদিন থেকে তার চাকরিও স্থায়ী হবে। এ ছাড়া ধারা ১১ (৩) অনুযায়ী, কোনো শিক্ষানবিশ সফলভাবে শিক্ষানবিশকাল শেষ না করলে এবং চাকরিতে স্থায়ী না হলে তিনি বেতন বৃদ্ধির অধিকারী হবেন না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
প্রবিধানের জটিলতা এড়াতে মুচলেকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩০৬তম বোর্ড সভা। আর এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বেবিচকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তাদের দাবি, প্রবিধান অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে যেটা পাওয়ার কথা, সেখানে মুচলেকা দিয়ে ভবিষ্যতে টাকা ফেরত দেওয়ার শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে- এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং চাকরি প্রবিধানের লঙ্ঘন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলেন, বর্ধিত বেতন তুলতে এমন শর্ত ‘মনগড়া’ ও আইনবহির্ভূত। সরকারি চাকরির প্রবিধানমালায় কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তার চাকরি সরাসরি স্থায়ী হওয়ার বিধান রয়েছে। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বর্ধিত বেতন পেতে এ ধরনের আজব নিয়ম এর আগে কেউ কখনও শোনেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের এক কর্মচারী আমাদের সময়কে বলেন, বেতন বৃদ্ধি আটকে থাকায় এতদিন বিপর্যস্ত ছিলাম। এর মধ্যে এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে আমাদের বিপদ আরও বেড়ে গেল। যথাযথ নিয়ম মেনে চাকরিতে ঢুকেছি। এখন বৈষম্যের শিকার হতে হবে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, বোর্ডের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে প্রবিধান অনুযায়ী ইনক্রিমেন্ট কার্যকর করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে অডিট আপত্তির দায় কর্মচারীদের ওপর চাপানোর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
এসব কর্মীকে হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বেবিচক কর্তৃপক্ষ। বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) এস এম লাবলুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, শিক্ষানবিশ এই ৮৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্থায়ীকরণের বিষয়টি বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। সেখান থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে আমাদের কাছে আসবে। যত দ্রুত সম্ভব তাদের স্থায়ী করা হবে। সুতরাং এ নিয়ে হতাশার কিছু নেই। বর্ধিত বেতন পেতে মুচলেকা দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত, কারও একার সিদ্ধান্ত নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বোর্ড সর্বোচ্চ অথরিটি। বোর্ড যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সেভাবেই প্রশাসন বিভাগ থেকে অর্থ বিভাগে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।