সাতক্ষীরায় সরকারি পাঠ্যবইয়ের বড় অংশ অপচয় হচ্ছে!

মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল, সাতক্ষীরা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৪০
শেয়ার :
সাতক্ষীরায় সরকারি পাঠ্যবইয়ের বড় অংশ অপচয় হচ্ছে!

সাতক্ষীরা আদর্শ দাখিল মহিলা মাদ্রাসা। ১৭ আগস্ট সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের তিন কিলোমিটার দূরের এই মাদ্রাসায় গিয়ে কোনো শিক্ষার্থী চোখে পড়লো না। শিক্ষকদের ঘরে টেবিলের ওপর রাখা হাজিরা খাতাগুলোর পাতা উল্টে দেখা গেল, ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর নামই নেই। নবম শ্রেনির হাজিরা খাতায় তিনজনের নাম থাকলেও কোনো উপস্থিতি নেই। 

প্রতিষ্ঠানের সুপার মো. আব্দুল মমিন বললেন, ‘দু-একদিনের মধ্যে ঠিকঠাক করে ফেলব।’ কোনো ছাত্রী নেই অথচ নিয়মিত সরকারি পাঠ্যবই নিচ্ছেন কেন? তিনি বললেন, ‘যা লাগে ব্যবহার করি, বাকী বই ফেরত দেই। এমপিও না হওয়ায় এমন অবস্থা।’ 

প্রতিষ্ঠানটি ২০২৫ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ২৫ সেট বিনামূল্যের সরকারি পাঠ্যবই নিয়েছে। বইয়ের সংখ্যা ৪২৫ টি। অথচ হাজিরা খাতা অনুযায়ী এই শ্রেণিতে কোনো শিক্ষার্থীই নেই। নবম শ্রেণির হাজিরা খাতায় তিন জনের নাম। বই নেয়া হয়েছে ২০ সেট। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে ৫৬৭ শতাংশ বেশি। অতিরিক্ত বইয়ের সংখ্যা ৩৪০টি। 

গত ১৭ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের ১২টি বিদ্যলয় ও ৮টি মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকৃত শিক্ষার্থীর চেয়ে অতিরিক্ত বই নিচ্ছে। বিষয়টি বোঝার জন্য ২০২৫ সালের ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির হিসাব বিশ্লেষণ করেছে আমাদের সময়। 

উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১১৪ টি। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬২টি, মাদ্রাসা ৪৬টি এবং ভোকেশনাল

৬টি। সরকার সকল শিশুর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীপ্রতি মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে গড়ে ১৪টি বইয়ের এবং মাদ্রাসা পর্যায়ে গড়ে ১৭টি বইয়ের একটি করে সেট দেয়। বইয়ের সেট দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, চাহিদার তালিকা যাচাই করা সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত বইগুলো নষ্ট হয়, প্রতিষ্ঠানে বা অফিসে বছরের পর বছর পড়ে থাকে।

অতিরিক্ত বইয়ের ছড়াছড়ি 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ও তাদের বিপরিতে বই গ্রহনের সংখ্যার তথ্য-উপাত্তের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এমন একটি স্কুল ৫০ সেট বই নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯০টি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অতিরিক্ত বই গ্রহন করেছে। এই প্রবণতায় মাদ্রাসাগুলি কিছুটা এগিয়ে।

সাতক্ষীরা টাউন গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে ৫২ ছাত্রী। স্কুলটি বই নিয়েছে ১০০ সেট। তারা ৪৮ সেট বা প্রায় ১০০ শতাংশ অতিরিক্ত বই নিয়েছে। নবম শ্রেণির জন্য নিয়েছে অতিরিক্ত ৩৮ শতাংশ সেট, যা সংখ্যায় ৩০৮টি। 

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের খেজুরডাঙ্গা আর. কে. মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ১০৫ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির জন্য ৩৭ শতাংশ সেট বই বেশি নিয়েছে। 

সাতক্ষীরার সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস মাধ্যমিক বিদ্যালয় ষষ্ঠ শ্রেনির ১৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ সেট বা ২৩৩ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির জন্য ৬৭ শতাংশ অতিরিক্ত সেট বই নিয়েছে।  

সাতক্ষীরা এ করিম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নবম শ্রেণিতে ৬০ সেট বা ৭৭ শতাংশ অতিরিক্ত বই নিয়েছে।   

শহরের কামালনগর উদয়ণ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নবম শ্রেণির জন্য ৭২ শতাংশ সেট অতিরিক্ত বই নিয়েছে, যা সংখ্যায় ৩২২ টি

বই। সাতক্ষীরা প্রাণনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ষষ্ঠ শ্রেনির ৫১ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১০০ সেট প্রায় ১০০ শতাংশ সেট অতিরিক্ত বই নিয়েছে।

আটটি মাদ্রাসায় সাধারণভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ। সাতক্ষীরা পৌরসভার মধ্যে অবস্থিত রইচপুর আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা ষষ্ঠ শ্রেণির ২৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরিতে ২২০ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ২৩ জন শিক্ষার্থীর বিপরিতে ৫২ শতাংশ অতিরিক্ত সেট বই নিয়েছে।

সাতক্ষীরা শহরের বাইপাস রাস্তার ধারে অবস্থিত লাবসা দাখিল মাদ্রাসা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২১জন শিক্ষার্থীর বিপরিতে ১৩৮ শতাংশ এবং নবম শ্রেণিতে ১৩ জন শিক্ষার্থীর বিপরিতে ৩২৩ শতাংশ অতিরিক্ত বই নিয়েছে।

 সদর উপজেলার সাতানী কুশখালী দাখিল মাদ্রাসা ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ৩৭ শতাংশ এবং ৯বম শ্রেণির জন্য ৪৫ শতাংশ সেট অতিরিক্ত বই নিয়েছে।  

ফিংড়ি মজিদিয়া আলিম মাদ্রাসা ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ২০ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ১০০ শতাংশ সেট অতিরিক্ত বই নিয়েছে। 

গুদামে বই, সরকারের ক্ষতি 

অনেক প্রতিষ্ঠানের অফিসে বা গুদামে অনেক বই পড়ে থাকতে দেখা গেছে। জেলা শিক্ষা অফিসের তিনতলায় কয়েক হাজার বই পড়ে আছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অতিরিক্ত বই পরে বাজারে বিক্রি করে দেয় এমন অভিযোগও রয়েছে। এ বছরের ৩১ জানুয়ারি দেবহাটার সখিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ৩ ভ্যান সরকারি বই বিক্রি করার ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। 

সরকারের বইগুলো ছাপে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে বই ছাপাতে তাদের বইপ্রতি ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে।  

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন অধিকারকর্মী সাকিবুর রহমান বাবলা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অতিরিক্ত বই নেয়ার প্রবনতা বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। আমাদের মত গরীব রাষ্ট্রের জন্য এটি খুবই দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা অনলাইনে উন্মুক্ত করে দিলে অতিরিক্ত বই নেয়ার প্রবণতা কমবে।’ 


অতিরিক্ত বই কেন? 

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহা. আবুল খায়ের বলেন, ‘২০২৫ সালে জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭ টি বই বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দেয়া চাহিদার ভিত্তিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে এসব বই বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া, জেলায় ২৭ টি ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানগুলি বইয়ের চাহিদা দিয়েও পরে সেই বই নেয় না।’ এসব বই তাঁর অফিসে পড়ে আছে। 

সদর উপজেলা সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা (সদ্য অবসরে যাওয়া) নারায়ণ চন্দ্র সরকার বলেছিলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীর ক্ষেত্রে দুরত্বের বিষয়টি না মানায় অনেক প্রতিষ্ঠানে কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী নেই। শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরেও পড়ে। তখন বই স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। জনবল স্বল্পতার কারণে চাহিদাপত্রের সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয় না।’  

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ গত ১ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে নবম শ্রেণিতে উপস্থিতির হার পেয়েছেন ২১ শতাংশ। বিষয়টি নিয়ে তিনি তার নিজস্ব ফেসবুকে একটি স্টাটাসও দিয়েছেন। তিনি ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুম্মার নামাজের আগে দেয়া বক্তব্যে বলেন, যত্রতত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত লেখাপড়া হচ্ছে না। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে না। শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে কচিং করাতে বেশী মনোযোগী। 

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য বলছে, সাতক্ষীরা আদর্শ দাখিল মহিলা মাদ্রাসা থেকে ২০২৫ সালে ২২ জন ছাত্রী দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন। পাশ করেছেন ৪ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সদর উপজেলার ফিংড়ি ইউনিয়নের এল্লারচর দাখিল মাদ্রাসার ছাত্রী এখানে ভর্তি দেখিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের। 

সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল হামিদ বলেন, ‘স্কুলের এমপিও বাঁচিয়ে রাখা, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বহাল রাখা, নতুন এমপিওভুক্তির আবেদন করার জন্য কাম্যশিক্ষার্থী না থাকার পরও তারা বছরের পর বছর প্রকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা গোপন রেখে বিনামুল্যের অতিরিক্ত পাঠ্যবই নিয়ে থাকেন।’ 

এই অধ্যাপক বলেন, ‘এতে সরকারের অর্থের অপচয় হয়। অতিরিক্ত এসব বই বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেয়া হয়। বিষয়টি সরকারের ভাবনায় নেয়া দরকার।’ 

তবে আশার কথা শোনাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি। এবার অতিরিক্ত এসব বই নিয়ন্ত্রনে বেশ কিছু কার্যকরি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি। তাদের উদ্যোগে এবার সবগুলো স্তর মিলিয়ে ১০ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে। ২০২৫ সালে এনসিটিবি নতুন পাঠক্রমের দশম শ্রেনির বইসহ ৪০ কোটির মতো বই ছেপেছিল। ২০২৬ সালে তা ৩০ কোটিতে নেমে আসবে।

ঠেকানোর উপায় কী 

এনসিটিবি’র সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘একটি বইও যাতে অতিরিক্ত ছাপা না লাগে সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। বর্তমানে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে বইয়ের তালিকা নেয়া হয়। ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে সরাসরি স্কুলগুলি থেকে তালিকা নেয়া।’ বই দেয়ার পর এনসিটিবি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘোষনা ছাড়াই সারপ্রাইজ ভিজিট করে শিক্ষার্থী সংখ্যা যাচাই করারও চিন্তা করছে এনসিটিবি। তিনি মনে করেন, এসব উদ্যোগের ফলে আগামীতে বইয়ের প্রকৃত চাহিদা নিশ্চিত

করা যাবে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি ও নবম শ্রেণির জন্য বিভাগ নির্বাচন প্রতি বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে নিশ্চিত করা গেলে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে বইয়ের চাহিদা পাঠানো হলে প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যাবে। 

তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে আমাদের সময়কে বলেন, ‘এটি একটি জাতীয় অপচয়। অনেক সময় এসব পাঠ্যবই বাজারেও বিক্রি হয়। অনেক অভিভাবকরা তাদের সন্তানের জন্য আগেভাগে এই বই বাজার থেকে কিনে দেন। সরকারি বইগুলি মুলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের মাধ্যমে দেয়া হয়। বইয়ের চাহিদা নেয়ার পর কিছু প্রতিষ্ঠানে র‌্যনডম চেক করা দরকার। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া গেলে এই প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।’