এক বিমানের যাত্রীদের তুলে দেওয়া হলো অন্য বিমানে
বিদেশগামী যাত্রীর জন্য মাসখানেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করা থাকে ফ্লাইট শিডিউল ও সুনির্দিষ্ট নম্বর সংবলিত উড়োজাহাজ। যথাসময়ে হাজির হয়ে বোর্ডিংকার্ডসহ সব কাগজ যাচাইয়ের পর ওই ফ্লাইটে উঠতে পারেন যাত্রীরা। তার আগে অন্তত ৬টি চেকপোস্ট পাড়ি দিয়ে তবেই বিমানে চড়তে পারেন তারা। এভাবে সব প্রক্রিয়া শেষে গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে (মদিনা রুটের বিজি-৩৩৭) ওঠেন ২৭২ যাত্রী। ১৫ মিনিট রানওয়েতে চক্কর কাটার পর ভ্রম কাটে যাত্রী ও বিমান কর্মকর্তাদের।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি আগের জায়গায় ফেরত আসার পর তারা জানতে পারেন- আদতে এই বিমানটি দোহা রুটে চলাচলের জন্য রাখা হয়নি। সিডিউল অনুযায়ী নির্ধারণ করা ছিল দোহা রুটের বিজি-৩২৫ ফ্লাইটটি। রহস্যজনক কারণে যাত্রীদের তুলে দেওয়া হয় মদিনা রুটের বিজি-৩৩৭ ফ্লাইটে। বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দরে তোলপাড় শুরু হলে প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এখন বিমানের প্রকৌশল ও ফ্লাইট অপারেশন বিভাগ একে অন্যকে দোষারোপ করে দায় এড়াতে চাইছে। এ ঘটনায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয় ২৭২ যাত্রীকে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও চোরাকারবারি চক্র বিমান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এভাবে বিমান বদল করে চোরাই পণ্য বহন ও খালাসের নজির রয়েছে বিশে^র বিভিন্ন দেশে। গত শুক্রবার রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরেও এমন ঘটনা ঘটছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বিমান কর্মকর্তারাই। আবার বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কোনো মহল এই কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে উড়োজাহাজ বদল কার নির্দেশে, রহস্যজনক কারণে ঘটনার এক দিন পার হলেও তা জানতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। আরও উদ্বেগের বিষয়, এমন একটি ঘটনা ২৪ ঘণ্টায়ও জানতে পারেননি বিমানের মুখপাত্র!
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বিমানের মুখপাত্র (মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ) বুসরা ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, বিমানবন্দরে এক বিমানের বদলে অন্য বিমানে যাত্রীদের পরিবহনের বিষয়ে তিনি অবগত নন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, অনিয়ম, যান্ত্রিক ত্রুটি আর দায়িত্বহীনতা যেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত ফ্লাইট পরিচালনা করতে নির্ধারিত উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বা নির্দিষ্ট কোনো কারণে সেই উড়োজাহাজে ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব না হলে উড়োজাহাজ পরিবর্তন করার নিয়ম রয়েছে। সেক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা মানা হয়নি। কোনো কারণ ছাড়াই গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উড়োজাহাজ পরিবর্তনের ঘটনাটি ঘটেছে। শেষে উড্ডয়ন শুরু করেও ফেরত আসেন পাইলট। পরে দেখা যায়, উড়োজাহাজটিতে রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি। এদিকে ঘটনার দায় নিতে চাইছেন না কেউ। দোষ চাপাচ্ছে একে অন্যের ওপর। এ ঘটনায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ২৭৮ যাত্রীকে।
আরেক কর্মকর্তা জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে কাতারের দোহার উদ্দেশে যাওয়ার কথা ছিল বিমান বাংলাদেশের বোয়িং ৭৮৭ ড্যাশ-৮ এস-২এজেডইউ উড়োজাহাজের বিজি-৩২৫ ফ্লাইট। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে একই সিরিজের বোয়িং এস-২ এজেএস উড়োজাহাজের বিজি-৩৩৭ ফ্লাইটে যাত্রী তুলে উড্ডয়ন শুরু করেন পাইলট। রানওয়েতে কিছুক্ষণ রান করার পরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আবার ফিরে আসেন তিনি। তখনই নজরে আসে ফ্লাইট পরিচালনা করার জন্য যে উড়োজাহাজ নির্দিষ্ট ছিল সেটি এই ফ্লাইট নয়। পরে যাত্রীদের নামিয়ে নির্দিষ্ট উড়োজাহাজে তুলে ফ্লাইট শুরু করতে পেরিয়ে যায় ৩ ঘণ্টারও বেশি সময়। শুক্রবার রাত ৯টার পর ফ্লাইটটি দোহার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, যে উড়োজাহাজটি এসাইন করা ছিল সেটিতে কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু যেটা প্রথমে নেওয়া হয়েছে সেটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এটা কে বদলাল, কার নির্দেশে হলো- সেই দায়দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। অপারেশন বিভাগ বলছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ পরিবর্তন করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বলছে, অপারেশন বিভাগ পরিবর্তন করেছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) মফিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, সিঙ্গেল যাত্রীকেও এক বিমানের বদলে অন্য কোনো বিমানে তুলে দেওয়ার নিয়ম নেই। এটা হলে ওই যাত্রীকে অন্য দেশে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। শুক্রবারের ঘটনায় ভিকটিমের সংখ্যা আড়াইশরও বেশি- এটা চরম দায়িত্বহীনতা। এর দায় বিমান কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। ঘটনায় জড়িত সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।