সাংবিধানিক আদেশে মৌলিক সংস্কার বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করবে: সাইফুল হক

সাক্ষাৎকার

শাহজাহান মোল্লা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সাংবিধানিক আদেশে মৌলিক সংস্কার বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করবে: সাইফুল হক

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক। জুলাই সনদসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য, জাতীয় নির্বাচন এবং জোটের সম্ভাবনা ও ইসলামপন্থি দলগুলোর প্রভাব- ইত্যাদি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার শাহজাহান মোল্লা-

আমাদের সময় : আগামী বছর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় দেখেন কি?

সাইফুল হক : নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার বা নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দিষ্ট তারিখ ছাড়া একটা ধারণা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনবিষয়ক কাজ অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও বাহ্যিক দিক থেকে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যারা রাজপথে বিক্ষোভের কর্মসূচি দিচ্ছে, তারাই কিন্তু সবার আগে ৩০০ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। তারপরও মানুষের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ ও অবিশ^াস তৈরি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না। এ প্রশ্ন সামনে এসেছে কিছু রাজনৈতিক দলের আচরণের কারণে। তারা এমন কিছু বিষয় হাজির করছে, যেগুলো কমিশনের বৈঠকে কোনো আলোচনাতেই ছিল না। পিআর পদ্ধতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনে নিম্ন কক্ষে পিআর নিয়ে আলোচনাই ছিল না। কেবল উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারটি আলোচনায় ছিল। আমরা ২৫টি দল উচ্চ কক্ষে পিআরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। সেটাও নোট অব ডিসেন্টসহ।

এখন কোনো কোনো দল দাবি করছে, সব নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। এটা উদ্ভট এবং হাস্যকর। আমার মনে হয় এটা সরকারকে চাপে রাখার কৌশল। জুলাই সনদের বিষয়ে আমরা একমত। এখন শুধু স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আলাপ-আলোচনা করে একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারলে দেশের জন্য ভালো। দলগুলোর ভেতরে সদিচ্ছা কাজ করলে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সমস্যা হবে না। যদি এমন হয়, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ঠিক না করে নির্বাচনেই আসবে না এবং নির্বাচনটাই হতে দেবে না, তাহলে বুঝতে হবে ওই এজেন্ডার মধ্যে অন্য কিছু আছে। সেটা হলে দুর্ভাগ্যজনক। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়েছি। মতভিন্নতা দূর করে বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কাটিয়ে ওঠার। এটা নিয়ে যেন অচলাবস্থা তৈরি না হয়, তার জন্য আমরা দলগুলোর সঙ্গে বসছি।

আমাদের সময় : অনেক দল গণভোট বা সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি করেছে। এ বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী?

সাইফুল হক : সাংবিধানিক আদেশ জারি করার এখতিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রপতির। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে কিছু করা হলে সেটা খুবই বাজে নজির, ভয়ংকর ও বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। তার মানে ভবিষ্যতে সংবিধান পরিবর্তনে আর সংসদ লাগবে না। তখন রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করেই সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে। এটা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের জন্য আত্মহত্যার শামিল। এতে ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী বীজ বপন করা হবে।

আমাদের সময় : সংবিধান বাতিল করে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?

সাইফুল হক : নির্বাচনের আগে গণভোটের প্রশ্ন নেই। এতগুলো বিষয়ে ভিন্নমত রেখে, নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে গণভোটের প্রশ্নটাই অবান্তর। ভোটাররা কোন বিষয়ে মতামত দেবে? তারা কি নোট অব ডিসেন্টের পক্ষে মত দেবে? নাকি ঐকমত্যের জায়গায় দেবে? আবার কোনো কারণে যদি না সূচক ভোট বেশি পড়ে, তাহলে পুরো সংস্কারটাই উল্টে যাবে। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। গণপরিষদের নির্বাচন যৌক্তিক না। গণপরিষদ নির্বাচন তখন হয়, যখন সাংবিধানিক শূন্যতা থাকে। এই সরকার শপথ নিয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে। সংবিধান ছুঁয়ে তারা শপথ নিয়েছে। গোটা রাষ্ট্র চলেছে সংবিধানের আলোকে। আমাদের ভিত্তিটা বিদ্যমান সংবিধান। গণপরিষদ নির্বাচন হলে আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। গণপরিষদে যেতে হলে ৩০টি রাজনৈতিক দলের মতামত লাগবে। তাতে ঝামেলা বাড়বে।

আমাদের সময় : সম্প্রতি ইসলামপন্থি দলগুলোর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আগামী রাজনীতি কেমন হবে?

সাইফুল হক : গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াতের আধিপত্য বেশি দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার জিম্মি হয়ে যাচ্ছে কি না- নাগরিকদের মধ্যে এমন প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের আচার-আচরণে প্রবল বৈষম্য দেখা দিয়েছে। সংলাপে বা যে কোনো জায়গায় বিএনপির সাথে জামায়াত, এনসিপিকে ডাকে; কোন ক্যাটাগরিতে ডাকে? এটা সরকারের দিক থেকে স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। সরকারের ভেতরে তাদের মতাদর্শের লোক আছে কি না জানি না, তবে সচিবালয় ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় তাদের চিন্তা-আদর্শের লোক আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির প্রতি সরকার পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের সন্তুষ্ট রেখেই সরকার কাজ করছে। সরকারের নিরপেক্ষতা গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকলে এই সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে কি না- প্রশ্ন উঠবে। এটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলবে। সেই প্রশ্ন আজ না হোক কাল আসতে পারে। জাতিসংঘে এনসিপির প্রতিনিধি কীভাবে ডাকে? এটা চলতে থাকলে এই সরকার কীভাবে পক্ষপাতহীন নির্বাচন করবে? সরিষার ভেতর ভূত থাকলে ভূত তাড়াব কীভাবে? এটা রাজনীতিকে অনেক জটিল জায়গায় নিয়ে যাবে।

আমাদের সময় : আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কোনো জোট করার পরিকল্পনা আছে কি?

সাইফুল হক : আমরা টেবিলের আলোচনাগুলো টেবিলেই মীমাংসা করতে চাই। ইসলামী দলগুলোর মতো মাঠের কর্মসূচি দিয়ে বাড়তি চাপ তৈরি করতে চাই না। জনগণের গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে রাজপথে আছি। আমরা চেষ্টা করব টেবিলের বাইরের দলগুলোর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে। এখন কখন কোন বিষয়ে সমঝোতা হবে বলা মুশকিল। বিএনপির সাথে আামাদের যুগপৎ আন্দোলনে সমঝোতা আছে। নির্বাচনী জোট হবে কি না, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি। তবে আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম, চেষ্টা করব নির্বাচনেও যাতে একটা বোঝাপড়া তৈরি করা যায়। কোন মাত্রায় ঐক্য হবে, সেটা বোঝা যাবে আগামী দিনগুলোতে।

আমাদের সময় : সম্প্রতি মাজার-দরগায় হামলার ঘটনা ঘটছে। এগুলো কীভাবে দেখছেন?

সাইফুল হক : এটা এক ধরনের মব। সরকার প্রচ্ছন্নভাবে যাদের মদদ দেয় তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাজনৈতিক মব সরকারের ছত্রছায়ায় হতে দেখেছি। সেই মবের সম্প্রসারণ মাজার ভাঙা। এখানে সরকার অকার্যকর। মানুষ যখন বুঝে ফেলে সরকার দুর্বল এবং অকার্যকর, তখন সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তার ঘটে। মাজার ভাঙা সামজিক নৈরাজ্যের প্রতিফলন। তৌহিদি জনতার নাম করে মব তৈরি করে; এর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একদল ধর্মের নামে মাজার করছে, আরেক দল ধর্মের নামে মাজার ভাঙছে। সরকারের অকার্যকারিতার জন্য এগুলো হচ্ছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এখনও পেশাদারত্ব আসেনি। প্রশাসন এখনও পেশাদারত্বে আসেনি। প্রশাসনে দলীয় আনুগত্য দেখা যাাচ্ছে। আগামী নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে হবে- এটার বিশ^াসযোগ্য পদক্ষেপ দেখছি না।

আমাদের সময় : জাপাসহ ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এটা রাজনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?

সাইফুল হক : সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দলকে, যাদের এক ধরনের জনভিত্তি আছে, এ ধরনের কোনো দলকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করাটা যৌক্তিক মনে করি না। এর অভিজ্ঞতা ইতিবাচক না। জনপ্রিয় কোনো দলকে নিষিদ্ধ করে তাদের নাই করে দেওয়া যায় না। নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান না। তাদের ব্যক্তিদের অপরাধ, তার জন্য প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার সুযোগ আছে। সরকার সেখানে ভালো যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি। বরং অনেককে নিরাপদে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দলের বিচারের প্রশ্ন উঠলে বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যাওয়া দরকার। নিষিদ্ধ করাটা অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়। উল্টো তাদের প্রতি সহানুভূতির জন্ম হয়। আওয়ামী লীগকে যেভাবে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটাও যৌক্তিক মনে করি না।

জাপা নিষিদ্ধ করার দাবিও যৌক্তিক না। এখন নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এর পেছনে আগামী নির্বাচনের সমীকরণ সম্ভবত কাজ করছে। যারা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রবল সক্রিয়, সম্ভবত তারা তাদের জন্য মাঠ খালি করতে চায়। তারা মনে করে, এই দলগুলো নির্বাচনের মাঠে থাকলে তাদের অসুবিধা হবে, তারা এই নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে বাড়তি সুবিধা পেতে চায়। এটা চলতে থাকলে বিপরীতটাও ঘটতে পারে ভবিষ্যতে। তখন অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি? তার মানে বিভক্তির রাজনীতি সৃষ্টি হবে। সরকার কি কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছে? এতে আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ থেকে যাবে। এক অংশকে বাইরে রেখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।