শিল্পায়নে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন বন্ধ

আবু আলী
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শিল্পায়নে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন বন্ধ

সারা বিশে^ শিল্পায়নে মূলধনের জোগান আসে পুঁজিবাজার থেকে। কিন্তু উল্টো পরিস্থিতি বাংলাদেশে। দেশে শিল্পায়নে মূলধন জোগানের প্রধান উৎস ব্যাংক খাত। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প খাতে পুঁজিবাজার থেকে কোনো অর্থায়ন আসছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও পুঁজিবাজারে কোনো আইপিও আসেনি। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, পতিত আওয়ামী লীগের সময়ে দেশের অর্থনীতিতে যে অরাজকতা চলেছে, তার কারণে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি সরকারি, বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির আইপিও আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ছোট ছোট কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে।

পুঁজিবাজারে এত দীর্ঘ সময় ধরে আইপিও না আসার নজির আর কখনও দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, ত্রুটিপূর্ণ আইপিও রুলস ও দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া, দীর্ঘ সময় অনিয়মের মাধ্যমে বাজে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, সহজ ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংস্কারপ্রক্রিয়া চলমান ও বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থা না থাকায় আইপিও আবেদন আসছে না।

জানা গেছে, দেশের পুঁজিবাজারে সর্বশেষ আইপিও অনুমোদন হয়েছে দেড় বছর আগে। ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের জন্য আইপিও অনুমোদন পায় টেকনো ড্রাগস। আর ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর আইপিও পায় এনআরবি ব্যাংক। এরপর আর কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হয়নি।

পুঁজিবাজারে আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানির তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিতর্কের অভিযোগ বেশ পুরনো। গত দেড় দশকে ১৪৯টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন সংগ্রহ করেছে, যার অধিকাংশই এসেছে খায়রুল কমিশনের মেয়াদে। এর মধ্যে অনেক কোম্পানিই এখন আর্থিকভাবে দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বেশকিছু কোম্পানির।

আইপিওর অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয়ের ঘটনাও দেখা গেছে। এ ছাড়া আইপিওতে আসার পর কৃত্রিমভাবে কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে এর মাধ্যমেও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আইপিওর আগে প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টাকা ছাড়াই উপহার হিসেবে প্লেসমেন্ট শেয়ার দেওয়া হয়েছে। এসব শেয়ার কোম্পানির তালিকাভুক্তির পর বাড়তি দামে বিক্রি করেছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে পুরো আইপিও প্রক্রিয়াকে ঘিরে অনিয়ম ও কারসাজির বড় ধরনের একটি চক্র গড়ে উঠেছে দেশের পুঁজিবাজারে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের প্রত্যাশা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে কাক্সিক্ষত সংস্কার না হলে ভালো উদ্যোক্তারা আইপিওতে আসতে আগ্রহী হবেন না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজারের উন্নত হয়নি। দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অবহেলা পুঁজিবাজারকে সংকুচিত করে রেখেছিল। সেখান থেকে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিসহ আমরা সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করছি। আমরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নিজেদের ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। আইপিও প্রক্রিয়া সহজীকরণের চেষ্টা করছি। এ ছাড়া লিস্টিং পরবর্তী সময়ে কমপ্লায়েন্স নিয়ে অভিযোগুলোর বিষয়ে ডিএসই রেগুলেটরদের কাছে তুলে ধরছে।

ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, ভালো উদ্যোক্তারা যদি সঠিক প্রাইসিং পায়, তাঁরা পুঁজিবাজারে আসবেন এবং আন্ডাররাইটারই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হিসেবে কাজ করবে। সংশোধিত আইপিও সিস্টেমে ভালো কোম্পানি আসতে পারবে এবং মন্দ কোম্পানিগুলো আটকানো যাবে। গ্রিন চ্যানেল ও ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ডিএসই দ্রুত আইপিও অনুমোদন দিতে পারবে। এজিএম নির্বিঘ্নে সম্পাদনের জন্য ডিজিটাল বা হাইব্রিড আকারে আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সমন্বয় করে একটি প্ল্যাটফর্ম করার মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিক লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) প্রেসিডেন্ট রূপালি হক চৌধুরী বলেন, দেশের পুঁজিবাজারকে অনেক বড় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা নিয়ে বেশি আলোচনা করার চেয়ে সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে বেশি আলোচনা জরুরি। নতুন নতুন আইডিয়া ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা দেখে যদি ছোট ছোট কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনা যায়, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে। একই সঙ্গে যারা তালিকাভুক্ত রয়েছে, তাদের কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো আরও সহজ করা প্রয়োজন।