বিশেষ সুবিধা নিয়ে অর্থ লোপাট কর্মকর্তাদের
বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করেছেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) কতিপয় কর্মকর্তা। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একটি জায়গা বরাদ্দ নিয়ে তাদের নয়ছয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা গেছে, বরাদ্দ নীতিমালা ভেঙে মো. শাহ আলম মোল্লা নামে এক ব্যক্তিকে সুবিধা দিতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা উধাও করে দিয়েছেন ওই কর্মকর্তারা। বিনিময়ে তাঁদের পকেটে ঢুকেছে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) আলমগীর হুছাইন ও সহকারী পরিচালক (অর্থ) মামুনুর রশীদ কৌশলে বিধিমালা কাটছাঁট করে কখনও ২১ শতাংশ, কখনও ১৬ শতাংশ, আবার কখনও ১১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি আদায়ের চিঠি বোর্ডে উপস্থাপন করেন। এই কাজে সহযোগিতা করেন হিসাবরক্ষক শাহীব উদ্দিন। সর্বশেষ ১১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। তার ভিত্তিতে চালান পাস করান আলমগীর হুছাইন। এ ধরনের চালান পাস করানোর ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই নীতিমালা অমান্য করেছেন তারা। তবে টাকা কম আদায়ের বিষয়টি একার সিদ্ধান্তে হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিযুক্ত আলমগীর হুছাইন। তিনি বলেছেন, ‘কাজটা আমি একা করেনি। আমি মাঝখানে ছিলাম। আগে-পরে অন্যান্য কর্মকর্তাও ছিলেন। তবে এত টাকা কম আদায় করার প্রশ্নই ওঠে না।’
তবে হিসাবে নয়ছয় পাওয়ায় একজন কর্মকর্তা ফাইলে স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘কাউকে সুবিধা দিতে বার বার বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার কাছে ন্যায়সঙ্গত মনে হয়নি, তাই আমি স্বাক্ষর করিনি।’
মিরপুরের রূপনগর গভঃ হাউজিং এস্টেট বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে ৬০ ফুট প্রশস্ত প্রধান সড়ক সংলগ্ন ৩নং প্রাতিষ্ঠানিক প্লাটটির পরিবর্তে সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকার সেকশন-৮, ব্লক-খ, প্রধান সড়কের ১নং পুনর্বাসন প্লটের পূর্ব দিকে অবরাদ্দকৃত কম/বেশি ২০ কাঠা জমি (খালি সাপেক্ষ) প্রাতিষ্ঠানিক প্লটের ফরমেট নকশা অনুমোদনসহ বিকল্প বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় জাগৃকের ২৬৮তম বোর্ড সভায়। তবে মূল বরাদ্দপত্রে ওই জমির পরিমাণের চেয়ে বিকল্প বরাদ্দকৃত প্লটের জমির পরিমাণ বাড়লে বাড়তি জমির মূল্য প্রচলিত মূল্যের দ্বিগুণ হারে এককালীন পরিশোধ করতে হবে এবং বিকল্প হিসেবে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ আদায় করতে হবে- এই ছিল বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত। প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দকৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্লটটির আয়তনের চেয়ে বিকল্প বরাদ্দকৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্লটটির আয়তন ৪.৮০ কাঠা বেশি হওয়ায় ওই ৪.৮০ কাঠা জমির মূল্য প্রচলিত মূল্যের দ্বিগুণ হারে এককালীন আদায় করার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
জাগৃকের সবশেষ প্লট/ফ্ল্যাট বরাদ্দ নির্দেশিকা, ২০০৮ (সংশোধিত-২০২৪) এবং সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৫৯ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা সংলগ্ন জমির প্রচলিত মূল্য প্রতি কাঠা ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত। ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী প্লটটির মূল্য হওয়ার কথা ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু বোর্ড সভায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার চালান পাস করা হয় গত ২৩ জুলাই। চালান প্রস্তুতকারীর জায়গায় স্বাক্ষর করেন হিসাবরক্ষক শাহাব উদ্দিন আর চালান পাসকারী কর্মকর্তার জায়গায় সহকারী পরিচালক (অর্থ) মামুনুর রশীদ। চালান পাস করার পর ২০২৫ সালের ২১ আগস্ট ২৬৮তম বোর্ড সভায় হিসাবে হেরফের দেখে আইন কর্মকর্তার মতামত নিতে বলেন বর্তমান চেয়ারম্যান মোসা. ফেরদৌসী বেগম। চালান পাস হয় জুলাইতে আর আইনি মতামত নিতে বলা হয় আগস্টে। অর্থাৎ, চালান অনুমোদনের সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আলমগীর হুছাইন আমাদের সময়কে বলেন, ‘টাকা কম নেওয়ার সুযোগ নেই। টাকা ধার্য করার এখতিয়ার আমার নেই। আর আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমার উপরে আরও অফিসার ছিলেন, আমি মাঝখানের লোক। তবে যাই হোক, টাকা কমা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
এ ছাড়া মিরপুর সেকশন-১০, ব্লক বি, মেইন রোডের ১৭৩ বাণিজ্যিক প্লট নং ১/এ-এর বকেয়া পরিশোধের বিবরণী থেকে দেখা গেছে, এখানে শাহজাহান মিয়া নামে আরেকজনের কাছে ২ হাজার ৪০০ বর্গগজ অর্থাৎ ৩০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয় জাগৃক। বরাদ্দ নির্দেশিকা ও সবগুলো বোর্ড সভার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় বিলম্বকালীন ফি/সুদ ছাড়া শুধু কিস্তির আসল টাকা পরিশোধ করা যাবে না। কিন্তু আলমগীর হুছাইন বিলম্ব ফি বাদ দেওয়ার জন্য সময় সময় হিসাব পরিবর্তন করেছেন। তিনি জাগৃকের প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে গত ২৭ মে প্লটটির জন্য ১৬ শতাংশ বিলম্ব ফিসহ ২ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা বকেয়া আদায় করার চিঠি প্রস্তুত করেন। কিন্তু চালান পাস করান ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার। বাড়তি ৭৫ হাজার ২০০ টাকার হিসাব দেখাতে পারেননি। জানা গেছে, এই ৭৫ হাজার ২০০ টাকাও গায়েব করার চেষ্টা করছেন আলমগীর হুছাইন। কিন্তু বরাদ্দ নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে আদায় করার কথা ৩ কোটি ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ২০০ টাকা। এখানেও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কারণ, শুরু থেকে ২১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি আদায় করার নির্দেশনা ছিল। সেটা কেটে ১৬ শতাংশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
প্রকৃত মূল্যের চাইতে কম মূল্য আদায় করার জন্য চালান পাসকারীর বক্তব্য জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক (অর্থ) মামুনুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘এটা আমার পর্যায়ে না। আরও আপার লেভেলে। চেয়ারম্যান এবং সদস্য লেভেলে আলাপ করলে প্রকৃত তথ্য জানতে পারবেন। বোর্ড সভায় যেভাবে সিদ্ধান্ত হয়, সেভাবেই অর্থ আদায় করা হয়। কারও কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এটা ভুল ধারণা।’