মাজার-দরগায় হামলা পেছনে কারা
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মাজার, দরবার শরিফ, পাগল-ফকিরদের আস্তানা, খানকা, এবং বাউল-ফকিরদের আখড়া-আস্তানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার হোমনায় একসঙ্গে ৪টি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। কখনও ‘তৌহিদী জনতা’র নামে, আবার কখনও ‘ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি’র নামেও এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। গত এক বছরে সংঘটিত মাজার ও দরগা শরিফে হামলাগুলোর ঘটনা বিশ্লেষণ করে অধিকাংশ ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
চলতি বছরের গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে মব সৃষ্টি করে (দলবদ্ধ সহিংসতা) স্থানীয় নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এমনকি নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। একই দিন রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করে একদল ‘তৌহিদী’ জনতা।
এসব ঘটনাকে উগ্রবাদী কর্মকা- হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা এসব ঘটনা ঠেকাতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন। সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, মাজারে হামলার ঘটনা কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। যারা এভাবে হামলা, ভাঙচুর করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একের পর এক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে মাজার শরিফ, দরগা শরিফে হামলা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করার চেষ্টা রয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এ ধরনের নৈরাজ্যের পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল পেছন থেকে কাজ করছে। আর এ ধরনের ঘটনা ঘুরেফিরে গোয়েন্দা দৈন্যতাকে সামনে আনছে। অতএব এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে সজাগ থাকতে হবে।
মাজারে হামলার নেপথ্যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্যও উঠে আসছে। ফলে বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব ও ছত্রছায়ার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে হামলার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীরা। প্রশাসন এসব ঘটনার বিরুদ্ধে বারবার সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও থামছে না। এক্ষেত্রে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে। একই সঙ্গে হামলার পর গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তির গতি এত ধীর যে, তা কার্যত ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে। বিশেষ করে যে এলাকায় এসব ঘটনা ঘটছে সেখানকার মানুষকে আতঙ্কিত করছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, মাজার শরিফ, দরগা খানকা শরিফ এ দেশে হঠাৎ করে হয়নি। এটা দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় হয়েছে। এগুলো বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। যদি সেখানে কোনো অনৈতিক কিছু হয় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তা জানানো দায়িত্ব। কিন্তু আইন হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, মাজার ভাঙা ইসলামের শিক্ষা নয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। যারা এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব ঘটনার নেপথ্যে কেউ যদি থাকে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ক্ষমতার পালাবদলের পর দলবদ্ধ সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের বাড়িঘরে হামলা হয়। এ ছাড়া নানা স্থাপনায় মব সৃষ্টি করে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মাজার, সুফি দরবার শরিফ, পাগল-ফকিরদের মাজার, দরবার শরিফ এবং বাউল-ফকিরদের আখড়া-আস্তানায় একের পর এক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার কঠোর আইন প্রয়োগের হুশিয়ারি দেওয়া হয়। তারপর মাঝে মধ্যেই হামলার খবর আসছে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে কী পরিমাণ মাজারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে তার পরিসংখ্যান প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি।
গত ১৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে দেশের কিছু এলাকায় ৪০টি মাজার এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪৪টি স্থাপনা ভাঙচুরের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। সবকটি ঘটনাতেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন থানায় ১৫টি নিয়মিত মামলা এবং ২৯টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা। দায়ের করা এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ২৩ জনকে।
বিশ^ সূফী সংস্থার হিসাবে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক মাজার, দরগা ও খানকা শরিফে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসছে না। সংস্থাটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য আফতাব আলম জিলানী আমাদের সময়কে বলেন, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। সুফিপন্থিদের ওপর এই ধারাবাহিক হামলা মানবতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর স্পষ্ট আক্রমণের শামিল। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মাজার-দরগা শরিফে হামলার বিরুদ্ধে পুলিশের অবস্থান কঠোর। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বদ্ধপরিকর। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ঘটনায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কুমিল্লার ঘটনায়ও পুলিশের অবস্থান কঠোর।