আলো নিভে যাচ্ছে সিনেমা হলের

ফয়সাল আহমেদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আলো নিভে যাচ্ছে সিনেমা হলের

বাংলাদেশের সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমা হলগুলো বহুদিন ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। দেশে এই মুহূর্তে মোট ১৪১টি হল থাকলেও তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে মাত্র প্রায় ৬০টি হল বছরভর চালু থাকে। এই ৬০টির মধ্যেও নতুন করে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিছু। হল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুই ঈদ ছাড়া সিনেমা হলগুলো তেমন দর্শক পায় না। তাই একের পর এক বন্ধের মুখে পড়ছে হলগুলো। এ ছাড়াও হলগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং পরিচালনার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ায়ও এসব বন্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।

যশোর জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম মণিহার সিনেমা হলটি ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সিনেমা হল একসময় ঢালিউডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এই হলে জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সিনেমা দেখতে আসতেন। ৪২ বছর আগে তৈরি হওয়া এই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল এবার ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, দেশের প্রায় ২৯টি জেলা এখন সিনেমা হলশূন্য। সমিতিটি জানিয়েছে, এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের বিখ্যাত অনেক সিনেমা হল। তার মধ্যে রয়েছে- গুলিস্তান, নাজ, বিউটি, স্টার, লায়ন, রূপমহল, শাবিস্তান, পূর্ণিমা, রাজমণি, মল্লিকা, পূরবী, পদ্মা, সুরমা, ডায়না, যমুনা, অভিসার, জোনাকি, আগমন, চিত্রামহল, অতিথি, মানসী, মুন। তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৪৪। এখন বড়মাপের সিনেমা হলের মধ্যে চালু আছে শুধু মধুমিতা। কিছুদিন আগেও চালু ছিল দোলাইরপাড়-জুরাইন এলাকায় অবস্থিত দুই প্রাচীন জমজ হল গীত ও সঙ্গীত। কিন্তু আর্থিক ও দর্শক সংকটে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে হল দুটি। নতুন ও মানসম্পন্ন দেশি চলচ্চিত্রের অভাব এবং দর্শক সংকটের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। হল কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্ধ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও আগামী বছরের ঈদে নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

গতকাল থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্স। ২০২১ সালে আধুনিকভাবে মধুবন চালু করা হলেও গতকাল থেকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আধুনিক এই হল। সিনেমা হলের মালিক রোকনুজ্জামান ইউনূস বলেন, ‘মধুবন একেবারে বন্ধ রাখছি। সিনেমা হল ভেঙে ওখানে কী বানাব এখনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারিনি।’ এদিকে যশোরের ‘মণিহার’ হলটি ভেঙে সেখানে মার্কেটের বর্ধিতাংশ হিসেবে আবাসিক হোটেল তৈরি করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিনেমা হলটির মালিক জিয়াউল ইসলাম মিঠু। গেল ঈদের পর বেশ মন্দা সময় পার করছেন বলে জানা গেছে। সিনেমা না থাকায় এখন হলটিতে কলকাতার সিনেমা চালাচ্ছেন তারা। তাতেও দর্শক মিলছে না। সিঙ্গেল হলটি ছাড়াও একটি মাল্টিপ্লেক্স হল ‘মণিহার সিনেপ্লেক্স’ থাকায় সেটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় রাজধানী ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত বিখ্যাত রাজমণি সিনেমা হলটি। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক না আসায় বছরের পর বছর লোকসান গুনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাজধানীতে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হাজার আসনের সিনেমা হল অভিসার। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার স্বনামধন্য আজাদ সিনেমা হলটি করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সব যন্ত্রপাতি, আসবাব ও আসন নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হওয়ার পথে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে অবস্থিত হাজার আসনের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘উর্বশী’র অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ডেমরার মতিমহল ও রানীমহলও নেই। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ২০টি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে আলমাস, দিনার, খুরশীদ মহল, নূপুর, জলসা, উজালা, রঙ্গম, উপহার, অলংকার, রিদম, পূরবী, সানাই, বনানী কমপ্লেক্সসহ প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। চালু আছে শুধু ‘সিনেমা প্যালেস’।

নারায়ণগঞ্জে বন্ধ হয়েছে আশা, মাশার, হংস, ডায়মন্ড। এখানে ছয়টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন চালু আছে গুলশান ও নিউ মেট্রো। যশোরে বন্ধ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিরালা। জামালপুর জেলার ২২টি সিনেমা হলের মধ্যে ২০টি সিনেমা হলের কোনো অস্তিত্বই নেই। জেলার দেওয়ানগঞ্জের ‘অন্তরাল’ ও সরিষাবাড়ীর ‘আলতা’ সিনেমা হল টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জামালপুরের ‘কথাকলি’, ‘এন্তেজার’, ‘নিরালা’, ‘সুরভী’, মেলান্দহের ‘কোয়েলী’, ‘পূর্ণিমা’, ‘আশা’, ‘রঙ্গনী’, নান্দিনার ‘অন্তরা’, ইসলামপুরের ‘মৌসুমী’, দেওয়ানগঞ্জের ‘জিলবাংলা হল’, ‘ভাই ভাই’, বকশীগঞ্জের ‘একতা’, ‘ঝংকার’, সরিষাবাড়ীর ‘চম্পাকলি’ এবং মাদারগঞ্জের ‘স্বজন’ সিনেমা হলের অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীনের দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি সিনেমা হল। একসময় যশোরের পরিচিতি ছিল সিনেমা হলের শহর হিসেবে। ছিল ২১টি সিনেমা হল। এখন যশোরে মাত্র ৫টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার ৩১ হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র সাতটি। খুলনা মহানগরীতে সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে মাত্র চারটি। ডুমুরিয়া উপজেলার একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। নেত্রকোনা জেলা শহরের একমাত্র সিনেমা হল হীরামন ও নাটোরের সায়াবাণী বন্ধ হয়ে গেছে।

সিলেটের সাতটির মধ্যে একটি এবং রংপুরের পাঁচটির মধ্যে একটি টিকে আছে। দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুরে বর্তমানে মাত্র একটি করে হল চালু রয়েছে। ঝিনাইদহে ১৭টির মধ্যে ৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০টির মধ্যে ৬টি, বেলকুচিতে ১৭টির মধ্যে দুটি, চুয়াডাঙ্গায় ১৪টির মধ্যে দুটি, নীলফামারীতে ২৪টির মধ্যে একটি, পাবনায় ২৮টির মধ্যে সাতটি, মানিকগঞ্জে নয়টির মধ্যে একটি, লক্ষ্মীপুরে ১০টির মধ্যে একটি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৫টির মধ্যে ছয়টি, রাজবাড়ীতে ২০টির মধ্যে দুটি, রূপগঞ্জে ছয়টির মধ্যে একটি, রংপুরে পাঁচটির মধ্যে একটি এবং সিলেটে সাতটির মধ্যে একটি সিনেমা হল চালু রয়েছে। গাজীপুরে ছিল ১৪টি সিনেমা হল, এর মধ্যে ১১টিই বন্ধ হয়ে গেছে।