সার সিন্ডিকেট ভাঙতেই নতুন নীতিমালা

তাওহীদুল ইসলাম
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সার সিন্ডিকেট ভাঙতেই নতুন নীতিমালা

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রাখা সার সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর হচ্ছে সরকার। নতুন নীতিমালায় দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, বিএডিসি-বিসিআইসি আলাদা ডিলার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া, ডিলারের সংখ্যা বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের দাবি, এতে শত শত কোটি টাকার সাশ্রয় হবে, ভর্তুকির চাপ কমবে এবং কৃষকরা সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন সার পাবেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ডিলার সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে।

এর অংশ হিসেবে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯’ সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বুধবার বিকালে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

কর্মকর্তারা জানান, সিন্ডিকেটের কারণে সর্বনিম্ন দরপ্রস্তাব নিয়ে ডিলাররা কারসাজি করে। এখন থেকে বাজারদর যাচাই করে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করে দেবে সরকার। এর ওপর দরপ্রস্তাব করে সার সংগ্রহ করতে হবে। এতে সরকারের বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে সরকার। সাধারণত কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেট করে একটি দরপ্রস্তাব করে কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। এখন থেকে সে সুযোগ আর থাকছে না। আগে বাজারদর মনিটরিং করা হতো না। প্রভাবশালী কারও পক্ষে তদবির করার সুযোগ বন্ধ। বরং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করলে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার।

সূত্রমতে, সারসংক্রান্ত আগের নীতিমালায় ডিলাররা বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) ও বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) ডিলার নামে পরিচিত ছিলেন। ডিলারদের কেউ কেউ ইউরিয়া সার আবার কেউ নন ইউরিয়া সার বিতরণকাজে নিয়োজিত। ফলে কৃষকদের পৃথক স্থান থেকে সার সংগ্রহে ধর্না দিতে হতো। এ বিভাজনকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে এক জায়গায় সব ধরনের সার পাওয়া যাবে। সব সার ডিলার সরকারি সার ডিলার হিসেবে বিবেচিত হবেন। বিএসডিসি বা বিসিআইসি নামে আলাদা সারের ডিলার হিসেবে নির্ধারণ সুযোগ বন্ধ হচ্ছে।

আরেকটি সূত্র জানায়, বর্তমানে একটি পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে- দেশে সার সংকট হতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সারের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সারের কোনো ঘাটতি নেই। ডিসেম্বরের পর সারের সংকট সৃষ্টির সুযোগ নেই। কারণ বিভিন্ন দেশ থেকে সার আনা প্রক্রিয়াধীন। অযথা বিভ্রান্তির চেষ্টা করছে একটি ডিলার সিন্ডিকেট যাদের কাছে জিম্মি থাকত দেশের সার ব্যবসায়ীরা।

মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, প্রস্তাবিত নীতিমালায় সার সরবরাহে নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। কৃষকের খরচ কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নীতিমালায় শর্ত যুক্ত করা হচ্ছে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে যেন জিম্মি না হয় দেশের মানুষ সেটি মাথায় রেখে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে করে দেশে কোনো ডিলার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চড়া দামে সার বিতরণের সুযোগ থাকবে না। বাড়ানো হবে ডিলারের সংখ্যা। বর্তমানে দেশে ১০ হাজার ৮১৪টি ডিলারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেসব ডিলার অনিয়মের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের লাইসেন্স বাতিলের মতো পদক্ষেপ নিতেও পিছপা হবে না সরকার।

সরকার বলছে, আগে একেক দেশের একই সারের জন্য একাধিক দরদাতা ভিন্ন ভিন্ন দরে সরবরাহের সুযোগ পেত। এতে সরকারকে টনপ্রতি ২০ থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত অতিরিক্ত গুনতে হতো। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। গত ১৯ আগস্ট প্রথম ধাপে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন সার সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময় ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬ প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত সরকারি দরে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সার সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সারের আন্তর্জাতিক বাজারদর নির্ধারণে বিশ্ব স্বীকৃত বুলেটিন ‘আর্গুস’ ও ‘ফার্টিকন’-এর মূল্য তালিকা অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের উৎপাদন সক্ষমতা ও দূরত্বের কারণে দাম ভিন্ন হতে পারে, তবে কোনো দেশ বা আমদানিকারককে ভিন্ন দরে সার দেওয়ার সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারের ডিলারদের অন্যায়ের খেসারত দিতে হয় কৃষককে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান আমাদের সময়কে বলেন, সারাদেশে পর্যাপ্ত সার মজুদ আছে। কোনো ঘাটতি নেই। অযথা কেউ যেন গুজব সৃষ্টির চেষ্টা না করে সে অনুরোধ করব। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করায় এবার বড় অঙ্কের সাশ্রয় হয়েছে। এর ফলে কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ আরও সাশ্রয়ী হবে এবং সরকারের ভর্তুকি খরচও কমবে।

কৃষি সচিব আরও জানান, সিন্ডিকেটের কারণে অনেকে নাখোশ হতে পারে। তারা বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। সবার আগে দেশ। কৃষককে বাঁচাতে ও সরকারের অর্থ সাশ্রয়ে মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর সুফল হিসেবেই সার আমদানিতে সাশ্রয় হচ্ছে বিপুল অর্থ।

জানা গেছে, সার নিয়ে নয়ছয় পুরনো কাহিনি। ভর্তুকির হাজার কোটি টাকার সার চলে যায় মাফিয়াদের পকেটে। এর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে- জাহাজ থেকে খালাস হলেও সরকারি গুদামে পৌঁছেনি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আমদানি করা ৭২ হাজার ৬৮০ টন ইউরিয়া। প্রায় ৫০৮ কোটি টাকার এই সার সরিয়ে নিয়েছে পরিবহন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন। সরকারকে ফাঁকি দিয়ে তিনি এই বিপুল পরিমাণ সার খোলাবাজারে বিক্রি করে টাকা লুটে নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। দশম জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র এমপি ছিলেন কামরুল আশরাফ খান পোটন। বহু বছর ধরে তিনিসহ হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সার ব্যবসা। আমদানি করা সার বন্দর থেকে সরকারি গুদামে সরবরাহে পরিবহন ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণও রয়েছে তাদের হাতেই।

জানা যায়, বিদেশ থেকে জাহাজে করে ব্যাগড ইউরিয়া সার আনার পর বন্দর থেকে সরাসরি গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। আর আমদানি করা বাল্ক ইউরিয়া নেওয়া হয় বিভিন্ন সার কারখানায়। দুই ক্ষেত্রেই সার স্থানান্তরের দায়িত্ব পরিবহন ঠিকাদারের। অথচ স্থানীয় পরিবহন চুক্তির ৪ (বি) ধারা অনুযায়ী ডেলিভারি চালান ইস্যুর পর ৫০ দিনের মধ্যে বাল্ক ইউরিয়া ও ৪০ দিনের মধ্যে ব্যাগড ইউরিয়া সার সংশ্লিষ্ট গুদাম বা কারখানায় সরবরাহ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ নিয়ে অনিয়ম বন্ধে কঠোর হচ্ছে বর্তমান সরকার। সম্প্রতি সার সরবরাহ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সরকারের দরপত্র প্রক্রিয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অভিমত আসছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৪৮টি প্রতিষ্ঠান এবার দরপত্রে অংশ নেয়। ১২টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় প্রথমে। ৪টি প্রতিষ্ঠানের সম্মতিতে কিছুৃটা শর্ত ছিল। পরবর্তী সময় স্পষ্টীকরণের মাধ্যমে তাদেরও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়েও কম দরে ডিলাররা সার সরবরাহ করবে এবার। উদ্দেশ্য সার আমদানিতে সরকারের সাশ্রয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ প্রক্রিয়ায় সার আমদানিতে সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। বাজারদর যাচাই করে দরপ্রস্তাবের বিষয়টি ডিলারদের একটি অংশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এতে তাদের সিন্ডিকেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লাভবান হয় সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, প্রথম ধাপের টেন্ডারে ডিএপি সার আনা হচ্ছে নোয়াপাড়া ট্রেন ইন্টারন্যাশনাল, মৌনতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, দেশ ট্রেডিং করপোরেশনের, মোশারফ অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স সুফলা ট্রেডিং করপোরেশন, সাইফুল্লাহ গালফ, এনআরকে হোল্ডিং, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। ডায়ামোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি বাংলাদেশের কৃষিতে জরুরি সার। ধান ও সবজিতে এর ব্যবহার বাড়ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবের তুলনায় সরকার কার্যাদেশ দিয়েছে জর্দান, মিশর ও চীন থেকে আনার জন্য। আমদানিযোগ্য সার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দেশভিত্তিক দর, দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ও কার্যাদেশ প্রদত্ত দর বিস্তর ফারাক। মিউরেট অব পটাশ বা এমওপি সারের চাহিদা বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম হলেও বিশেষ কিছু ফসল উৎপাদনে এটি অপরিহার্য। এ বছর রাশিয়া থেকে এমওপি আমদানির দর নির্ধারণ করা হয়েছে বাজার মূল্যের চেয়ে প্রতি মেট্রিক টনে প্রায় ৩ ডলার কমে। ফলে এমওপি আমদানিতে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। যদিও সাশ্রয়ের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, তবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া যে কার্যকরভাবে কাজ করছে তারই প্রমাণ এটি। ট্রিপল সুপার ফসফেট বা টিএসপি সার বাংলাদেশের কৃষিতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এবারের দরপত্রে এ সারে দামের পার্থক্য ছিল সবচেয়ে বেশি। মরক্কো ও লেবানন থেকে আমদানিকৃত টিএসপি সারের দর বাজার মূল্যের তুলনায় ৩৪ থেকে ১০৭ ডলার কমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মোট সাশ্রয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ সাশ্রয়ের ফলে কৃষি খাতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা হালকা হবে। বর্তমানে সার ভর্তুকির পেছনে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ খরচ কমানো গেলে কৃষির জন্য অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সর্বনিম্ন দরে সার সরবরাহে সম্মতপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আমদানিকারকদের অসম লাভের পথ সংকুচিত হয়।

নথিপত্র অনুযায়ী, সার আমদানি প্রক্রিয়ায় প্রতি টন সারের বাজার মূল্যের সঙ্গে জাহাজ ভাড়া, ডিসচার্জ খরচ এবং স্থানীয় পরিবহনসহ অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে আমদানিকারকরা দেশভিত্তিক দরপ্রস্তাব করে থাকে। কোনো একক দেশের পক্ষে একই সময়ে চাহিদার সম্পূর্ণ জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ পদ্ধতি প্রচলিত। এবার কিছু আমদানিকারক দরপ্রস্তাব প্রক্রিয়ায় প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে দেশভেদে ২৫ ডলার থেকে ১৫০ ডলার বেশি মূরে‌্য সার সরবরাহের প্রস্তাব করে। এ নিয়েই আপত্তির সূত্রপাত। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, উচ্চমূল্যের পরিবর্তে দেশভিত্তিক সর্বনিম্ন দরে সংগ্রহের। সে অনুযায়ী কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এতে করে সার আমদানিতে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।