ডুবন্ত টেশিসের জন্য দক্ষ নাবিক খুঁজছে সরকার

এম এইচ রবিন
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ডুবন্ত টেশিসের জন্য দক্ষ নাবিক খুঁজছে সরকার

এক কালে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের অন্যতম পথিকৃৎ রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) এখন লোকসানের চক্রে বন্দি। এক সময় দেশের টেলিফোন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মূল ভিত্তি ছিল এই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পুরনো উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সরকারি নীতিগত সহায়তার ঘাটতি- সব মিলিয়ে টেশিস আজ টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় টেশিসকে এগিয়ে নিতে এর শীর্ষ পদে দক্ষ লোক নিয়োগের চিন্তা করছে সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু কোম্পানি যৌথভাবে কাজের আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বও হয়েছে। একটি কোম্পানি ক্যাবল ও স্যাটেলাইট টিভির সেট-টপ বক্স উৎপাদন করবে, আরেকটি বিদেশ থেকে লিথিয়াম আয়ন সেল এনে ব্যাটারি অ্যাসেম্বল করার পরিকল্পনা করছে। তিনি জানান, অদক্ষ হয়ে পড়া ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সাফল্য আনতে লম্বা পথ হাঁটতে হবে টেশিসকে। তবে রিভার্স জার্নিটা শুরু হোক। আপাতত আমরা টেশিসে ইন্ডাস্ট্রি থেকে একজন দক্ষ এমডি নিয়োগের চিন্তা করছি।

জানা গেছে, অতীত গৌরব, বর্তমান হতাশা- টেশিস একসময় সরকারি টেলিফোন, পিএবিএক্স এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস মিটার উৎপাদনে এগিয়ে ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এসব পণ্যের চাহিদা কমে যায়। বাজারে সস্তা বিদেশি পণ্যের দাপটে পিছিয়ে পড়ে টেশিস।

গতকাল নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ফয়েজ আহমদ লেখেছেন- যুগোপযোগী পণ্য উদ্ভাবনে ব্যর্থতা, সম্পদ বেদখল, দুর্নীতি ও অপব্যবস্থাপনা টেশিসকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির চমৎকার লোকেশন, বড় প্রোডাকশন ফ্লোর ও কিছু অনন্য ফ্যাসিলিটি এখনও ব্যবহারযোগ্য। এগুলো কাজে লাগালে টেশিসকে আবার উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, সাধারণ মানের সুইচ, হাব, রাউটার, চার্জার, সিসি ক্যামেরা, টিভি অ্যাক্সেসরিজ কিংবা সেট-টপ বক্সের মতো অসংখ্য পণ্য বাংলাদেশ এখনও বিদেশ থেকে আমদানি করছে। অথচ এসব ‘লো-টেক’ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে টেশিসের সক্ষমতা গড়ে তোলা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হতো।

লোকসানের কারণ- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেশিসের লোকসানের প্রধান কারণ হলো প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা। বিশ্ব যখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, টেশিস তখনও অ্যানালগ ফোন ও এক্সচেঞ্জ তৈরিতেই আটকে রয়েছে। এ ছাড়া, পুরনো উৎপাদন পদ্ধতি ও উচ্চ খরচ পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা হ্রাস করেছে। বেসরকারি খাত কম খরচে উন্নতমানের পণ্য সরবরাহ করতে পারলেও টেশিস পিছিয়ে পড়ছে।

আরেকটি বড় সমস্যা নীতিগত দুর্বলতা ও বাজার প্রতিযোগিতা। সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও টেশিসের জন্য কোনো বাধ্যতামূলক ক্রয়নীতি নেই। ফলে সরকারি চাহিদাও তারা পূরণ করতে পারছে না। এ ছাড়া বারবার ওঠে এসেছে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগ। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, দুর্বল তদারকি এবং স্বচ্ছতার অভাবে প্রতিষ্ঠানটি আরও সংকটে পড়েছে।

টেলিকম বিশেষজ্ঞ ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, পুরনো পণ্যে আটকে থাকা আত্মহত্যার শামিল। সরকারের উচিত টেশিসকে গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি করা।

অন্যদিকে, টেলিকম বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ মনে করেন, টেশিসকে কেবল ঐতিহ্যবাহী পণ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ না থেকে স্মার্টফোন যন্ত্রাংশ সংযোজন, সিসিটিভি ক্যামেরা, আইওটি ডিভাইস, সোলার প্যানেল কিংবা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো খাতে প্রবেশ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নীতি সহায়তা ছাড়া টেশিসের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য টেলিকম পণ্য ক্রয়ে টেশিসকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে টেশিসের জন্য একটি নিশ্চিত বাজার তৈরি হবে।

উল্লেখ, টেশিসের সংকট কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই নয়, বরং দেশের শিল্পায়নের ইতিহাসে একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্ন। আধুনিকীকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি এবং গবেষণা-উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে টেশিস আবারও বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতে পারে।