ভর্তুকির টাকায় বোনাস উৎসব
বছরের পর লোকসান দিয়ে আসছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। লোকসান পুষিয়ে নিতে সরকারি বাজেট থেকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আর সেই ভর্তুকির টাকা থেকেই পেট্রোবাংলা ও এর ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের উৎসাহ বোনাস বা ভাতা দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি। তবে ভর্তুকির টাকায় এভাবে দেদার বোনাস বিতরণকে আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কিছু ভাতা-বোনাস স্বাভাবিক হলেও ভর্তুকিনির্ভর ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে এমন বিপুল পরিমাণ বোনাস বিতরণ করা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সবাই বোনাস পেতে পারে। তবে উৎসাহ বোনাস দেওয়া হয় কাজের গতি বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বছরের পর বছর একদিকে লোকসান দিয়ে অন্যদিকে ভর্তুকির টানা এনে বোনাস নেওয়া আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে পেট্রোবাংলা এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজেট থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে উৎসব বোনাস দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। অথচ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। আর জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মীরা তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিবছর কথায় কথায় বোনাস নিচ্ছেন। এতে জ্বালানি স্বার্থ বিঘিœত হচ্ছে। এর ফলে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানো যাচ্ছে না এই খাতে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
অডিট প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পেট্রোবাংলার আর্থিক বিবরণীতেও এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই অডিট প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, দেশের জ্বালানি খাত যেখানে বিপুল ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি পেট্রোবাংলা ও এর ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরে চুপিসারে ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা এক্স-গ্রেশিয়া (নৈতিক দায়জনিত বোনাস), শ্রমিক লাভ-অংশীদারি তহবিল ও প্রণোদনা বোনাস হিসেবে বিতরণ করেছে। আবার বিভিন্ন নামে এই বোনাস বিতরণের তথ্যও সরকারকে সঠিকভাবে সরবরাহ করা হয়নি। এতে দেখা যায়, করদাতাদের টাকায় টিকে থাকা কোম্পানিগুলো নিয়ম ভেঙে নিজেদের কর্মীদের মোটা অঙ্কের উৎসাহ বোনাস দিয়েছে। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান গুনেছে। আবার সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে বাজেট থেকে ভর্তুকির টাকা আনা হয়েছে। আর সেই ভর্তুকির টাকায় বিতরণ করা হয়েছে উৎসাহ বোনাস হিসেবে।
জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত গ্যাস খাতে সরকার ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরেই দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৭১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অথচ সেই সময়েই বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান নিয়ম ভেঙে ১ হাজার ২০০ কোটির বেশি টাকার বিভিন্ন বোনাস ও ভাতা বিলিয়ে দিয়েছে নিজেদের কর্মীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অডিটে প্রতিবেদনের দেখা যায়, তিতাস গ্যাস, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লোকসান করলেও এক্স-গ্রেশিয়া সুবিধা দিয়েছে, যা আর্থিক শৃঙ্খলার চরম লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ সময়ে নিয়ম ভেঙে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন (কেজিডিসিএল) ১৮২.৩৪ কোটি টাকা উৎসাহ বোনাস দিয়েছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস (বিজিএফসিএল) ৬৩.৮৫ কোটি টাকা উৎসাহ বোনাস দিয়েছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি (টিজিটিডিসিএল) ৪৬.০৫ কোটি টাকা প্রণোদনা বোনাস দিয়েছে, যা পেট্রোবাংলার সহযোগী কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া নিয়ম ভেঙে আরও বোনাস দিয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি। লোকসানে থাকা মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিংও বিপুল পরিমাণ এক্স-গ্রেশিয়া দিয়েছে।
এদিকে অডিট প্রতিবেদনে কিছু সুপাারিশও করা হয়েছে। সেখানে এসব নিয়মবহির্ভূত বোনাস নীতি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, লোকসানি প্রতিষ্ঠানে বোনাস নিষিদ্ধ করা জরুরি। কেবল বিশেষ অবদানের জন্য প্রণোদনা সীমিত করা। নীতিনির্ভর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা। ভবিষ্যতে সব বোনাস লাভজনকতা ও আর্থিক শৃঙ্খলার সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারে কাজ করলে জ্বালানি খাতে তেমন কোনো সংস্কার আনা হয়নি। এ জন্য জ্বালানি খাতে বোনাস নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।