রাজপথে শক্তি প্রদর্শনে অস্থিরতার আশঙ্কা
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্মকা-ে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও বর্তমানে বেশ তৎপর। সর্বশেষ, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাজপথে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এসব দল নিজেদের শক্তি জানান দিতে চাইছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল এরই মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছে। ইস্যু- জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোট নিষিদ্ধ করার দাবি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামীর রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ শক্তি- এ বার্তা দিতেই জামায়াতসহ সাতটি দল যুগপৎ এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এ কর্মসূচির জেরে ‘রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে’- এমন বার্তা রয়েছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কাছে। এ ছাড়া এ কর্মসূচি বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখার কৌশল বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যে কোনো দল দাবি আদায়ে কর্মসূচি দিতেই পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচি যদি আগামী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনীতিবিদরাও।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, দাবিগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পরকে যদি ছাড় না দেয়, তাহলে দেশের জন্য সমূহ সংকট তৈরি হবে। আর সেই সংকটের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই চিন্তা-ভাবনা করেই এসব কর্মসূচি করা উচিত।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতির দাবি করে আসছে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো। এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে আরও কিছু দল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিও করেছে দলগুলো। এসব দাবি আদায়ে তিন দিনব্যাপী যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক চলা অবস্থায় ‘পিআর পদ্ধতি’র দাবি আদায়ে জামায়াতের মাঠ কর্মসূচিকে স্ববিরোধিতা বলে মনে করছে বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় রাস্তায় কর্মসূচি দেওয়া অনেকটা স্ববিরোধিতা। তবে অবশ্যই যে কোনো দলের কর্মসূচি দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। তারা কর্মসূচি দিতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম আমাদের সময়কে বলেন, সমমনা দলগুলো একই দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে, এটাকে আমরা যুগপৎ বলব না। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালীন এ ধরনের কর্মসূচি স্ববিরোধী কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা স্ববিরোধী মনে করি না। জনমত মজবুত করতে এই কর্মসূচি। বরং ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা আরও সহায়ক হবে। এই দাবিটা জনগণের সে কথা আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে বারবার বলেছি। এই দাবিটা যে জনগণের, সেটা প্রমাণ করার জন্যই এই কর্মসূচি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের বিজয় জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোকে উৎসাহিত করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো প্রভাবক ও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, সেটা জাতির কাছে তুলে ধরতেই যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে- এমনটাই ভাবা হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তির নজর রয়েছে তাই বড় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তেমন বার্তাই দিয়েছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। গত রবিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
এই কর্মসূচি ঘিরে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বৈঠকে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলনে নামার প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোয় সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। অবরোধের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকের এমন বার্তায় দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ ও রাজনীতিবিদরাও শঙ্কিত। বিশেষ করে, গত সোমবার ফরিদপুর-৪ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসকে কেন্দ্র করে জেলার ভাঙ্গায় গড়ে উঠা আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। সেখানে থানায় হামলা, পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মো. রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্টরা ঢুকে সহিংসতা চালিয়েছে। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে আমি নির্দেশ দিয়েছি।
জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হতে পারে বলে আলোচনা উঠেছে, এ বিষয়ে আপনারা কী মনে করেন- জানতে চাইলে জামায়াতের আবদুল হালিম বলেন, সেটা আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের যে আকাক্সক্ষা ছাত্র-জনতার সংস্কার ও নির্বাচন। এই কর্মসূচি তার সহায়ক হবে। বরং জনগণের দাবি পাশ কাটানোর জন্য ওই সব অজুহাত সামনে আনা হচ্ছে। পিআর পদ্ধতির বিষয়ে আমাদের অবস্থান অনড়। এই দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ইসলামী দলগুলোর এমন যুগপৎ কর্মসূচি দেশের রাজনীতির পাশাপাশি বহির্বিশে^ কী বার্তা দিতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ চলছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ইসলামী দলগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের একটা ‘উত্থান’ ঘটেছে। এই ‘উত্থানে’র মাধ্যমে তারা একটা বার্তা দিতে চায়। বিএনপিসহ বড় দলগুলোকে টার্গেট করে তারা বার্তা দিতে চায় ‘রাজনীতিতে আমরা এখন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি’। তারা এখন আর ‘মার্জিনাল’ বা প্রান্তিক না; সেটা তারা প্রমাণ করতে চায় এই কর্মসূচির মাধ্যমে।
কর্মসূচি যাই দেওয়া হোক রাজনীতিতে জামায়াতের যে উত্থান তারা কখনই চাইবে না নিজেদের ক্ষতি নিজেরা ডেকে আনুক। এই কর্মসূচির মাধ্যমে অন্য কিছু করলে জামায়াত ইসলামী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন ড. সাব্বির আহমেদ। বিক্ষোভ কর্মসূচির আড়ালে বড় কিছু হলে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তখন বিএনপি লাভবান হবে। তাই তারা জেনেশুনে নিজেদের সুইসাইড করবে না। তারা যে পর্যায়ে এসেছে, এটা থেকে তারা পিছিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। রাজনীতিতে চাপ অব্যাহত রাখতেই মাঠে শক্তি দেখাবে।
জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের নিষিদ্ধের দাবি প্রসঙ্গে এই বিশ্লেষক বলেন, জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দল নিষিদ্ধ করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যে সময়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, একই সঙ্গে জাতীয় পার্টিকে করা হলে হয়তো কথা উঠত না। এখন সময় পার হয়ে গেছে।
আদর্শগতভাবে ইসলামী দলগুলোর বিপরীত মেরুতে রাজনীতি করে বাম দলগুলো। তারা এই কর্মসূচিকে কীভাবে দেখছে- জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, একটা দল তাদের মতো করে রাজনৈতিক বক্তব্য উত্থাপন করতে পারে। সেটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু এমন কোনো কার্যক্রম করা যাবে না, যার ফলে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আরপিওতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যেতে পারে। জুলাই সনদের অন্যান্য দাবি দলগুলো তাদের ইস্তেহারে যুক্ত করবে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে যারা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা তখন জনগণের মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। মনে রাখতে হবে দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তি আমাদের নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চায় এবং দেশকে অগণতান্ত্রিকতা ও রাজনীতিকরণের ফাঁদে ফেলতে চায়। কোনোভাবেই এই ফাঁদে পা ফেলা যাবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে যদি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিসহ সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। আর সেটা হলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই দলগুলোর উচিত দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক পরিকল্পনা করা।