বাগেরহাটে হেলাল-তন্ময় ছিলেন শেষ কথা
বাগেরহাট তথা দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতিতে এক সময় শেখ হেলাল উদ্দীন ও তাঁর ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের কথাই ছিল শেষ কথা। টেন্ডার, নিয়োগ, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মনোনয়ন বাণিজ্য- সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন এই বাবা-ছেলে। সাধারণ মানুষ মনে করতেন, তাঁরা যেন অঘোষিত মহারাজ। অথচ সময় বদলেছে। আজ তাঁদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্তত হাফ ডজন মামলা, যার মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, নাশকতা, বিস্ফোরক আইন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা। বর্তমানে তাঁরা আত্মগোপনে।
দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত ছিলেন শেখ হেলাল। মনোনয়ন ও নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরির বদলি, ঠিকাদারি, এমনকি আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গেও তাঁর নাম জড়িত ছিল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন ও বিতর্ক সৃষ্টি ছিল তাঁর স্বাভাবিক চর্চা।
বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময় ছিলেন স্থানীয় রাজনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোনো কাজ হতো না। শহরের মিঠাপুকুর পাড়ের বাড়িটিই ছিল টেন্ডার ও চাঁদাবাজির অর্থ ভাগাভাগির কেন্দ্র। স্থানীয় সূত্র বলছে, প্রভাবশালী নেতারাও তন্ময়ের অনুমতি ছাড়া কোনো কাজে হাত দিতে সাহস করতেন না।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকেই শেখ হেলাল ও তন্ময় গা-ঢাকা দিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শেখ হেলাল সরকার পতনের আগে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, পরে দ্রুত দেশে ফিরে ছেলে তন্ময়সহ ৯ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় চলে যান। তাঁদের ব্যক্তিগত সহকারীদের ফোনও বন্ধ থাকায় বর্তমান অবস্থান নিয়ে জেলাজুড়ে চলছে নানা আলোচনা।
শেখ হেলাল সচরাচর বাগেরহাটে অবস্থান করতেন না; কর্মসূচি শেষে খুলনা, টুঙ্গিপাড়া বা ঢাকার বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতেন। তবে তন্ময় নির্বাচনের আগেই বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুর পাড়ের একটি বাড়িতে থেকে দলীয় পদ বণ্টন, টেন্ডার ও চাঁদাবাজির অর্থ ভাগাভাগির কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন।
নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান তালুকদার বাগেরহাট সদর থানায় একটি মামলা করেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে আসামিরা তাঁর অফিসে গিয়ে ২০০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রথমে ৭ কোটি ৩০ লাখ এবং পরে ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য করেন তাঁরা। এ মামলায় এক আসামি শহীদুল ইসলাম গ্রেপ্তার হলেও হেলাল-তন্ময়সহ অন্যরা পলাতক।
জজকোর্টের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় শেখ হেলাল ও তন্ময়সহ ৯৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। ফকিরহাট থানায় আরও একটি মামলায় তাদেরসহ ১০১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও চাঁদাবাজিসহ অন্তত আরও চারটি মামলা করা হয়।
শেখ হেলালের নামে ফকিরহাট উপজেলার পিলজং এলাকায় দুই একর ও মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া এলাকায় ৪ দশমিক ৬ একর জমি রয়েছে। তন্ময়ের উল্লেখযোগ্য স্থাবর সম্পত্তির তথ্য না মিললেও তাঁদের ছয়টি ব্যক্তিগত গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে ব্যবসা রয়েছে শেখ হেলালের, যেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন তিনি।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। সাবেক এমপি শেখ হেলাল ও শেখ তন্ময়ের মামলার বিষয়ে জেনেছি। মামলাগুলোর তদন্ত কাজ চলছে, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়রা বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলের এই ‘মহারাজ’ বাবা-ছেলে এক সময় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আজ তাঁরা মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে। তাঁরা বলেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসন আমলে এলাকায় কোনো নিয়মই ছিল না। তাঁদের কথাই ছিল আইন। প্রশাসনের কারও প্রতি বিরাগভাজন হলে তৎক্ষণাৎ বদলি করা হতো। পটপরিবর্তনের পরও অজানা আতঙ্কে সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।