ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ফরিদা পারভীনের বিদায়
দিনভর প্রকৃতির কান্না আর মানুষের চোখের জল মিলেমিশে একাকার করে চিরবিদায় নিলেন লালন সম্রাজ্ঞী, কিংবদন্তি ফরিদা পারভীন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল রবিবার দুপুরে বৃষ্টির মধ্যেই ভক্ত, শুভানুধ্যায়ী ও সংস্কৃতিকর্মীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। হাতে শ্রদ্ধার ফুল, ভেজা কাগজে মোড়ানো মালা, আর চোখের জলে দুঃখের এক মর্মস্পর্শী ক্যানভাস ফুটে উঠেছিল যেন এ সময়। শেষবারের মতো শিল্পীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করছিল যেন প্রকৃতি ও মানুষ।
গত শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে মারা যান একুশে পদকপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। গতকাল রবিবার তেজকুনিপাড়ার বাসা থেকে ফ্রিজিং গাড়িতে শিল্পীর মরদেহ আসে ১১টার পর। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় ফরিদা পারভীনকে ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত করে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও অভিনেতা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমেদ সায়মন, জাতীয় কবিতা পরিষদ সভাপতি মোহন রায়হান, সাধারণ সম্পাদক রেজাউদ্দিন স্টালিন, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, তপন বাগচীসহ অনেকেই। ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম বৃষ্টি উপেক্ষা করে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ বেতার, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, জাতীয় কবিতা পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
শিল্পীগোষ্ঠী, নিজেরা করি, বাংলাদেশ মিউজিশিয়ান ফাউন্ডেশন, অচিন পাখি সংগীত একাডেমি প্রমুখ।
বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, এই শূন্যতাকে পূরণ করতে আমাদের সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। এমন গুণী শিল্পী যেন আমরা আরও পেতে পারি, সেই পরিবেশ গড়তে হবে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ফরিদা পারভীন দুটি ক্ষেত্রে অসাধারণ। লালনের গান পরিবেশনায় তার গায়কীতে ‘মধ্যবিত্ত ভাব’ প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছিল। লালনসংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি মধ্যবিত্তের কাছে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। শেষ পর্যায়ে তিনি জীবনযাপন করেছেন লালন সাধক হিসেবে। এ ছাড়া একজন শিল্পী হিসেবে তিনি সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা তৈরি করতে পেরেছেন; একাই একটি ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জাতীয় কবিতা পরিষদ সভাপতি কবি মোহন রায়হান বলেন, ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে কাঁদছে তার অসংখ্য ভক্ত, কাঁদছে প্রকৃতিও। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে তিনি এক অনন্য অধ্যায় ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন যোগ করেন, লালনের গান মানেই ফরিদা পারভীন, আর ফরিদা পারভীন মানেই লালনের গান।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় ফরিদা পারভীনের জানাজা। পরে মরদেহ নেওয়া হয় কুষ্টিয়ার উদ্দেশে, যেখানে পরিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে তাকে দাফন করা হবে। রাত ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ফরিদা পারভীনের মরদেহ কুষ্টিয়ায় এসে পৌঁছেনি। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে। এর আগে তার দাফনস্থল নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। স্বামী চাইছিলেন ঢাকায় মিরপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে। তবে সন্তানরা মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী কুষ্টিয়ায় দাফনের সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত সবাই তা মেনে নেন।
১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেন ফরিদা পারভীন। ছোটবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়। সংগীতে হাতেখড়ি ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। কর্মজীবনের শুরুতে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান গাইতেন। পরে লালনের গান তাকে এনে দেয় খ্যাতি ও মর্যাদা। ১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৮ সালে ফুকুওয়াকা এশীয় সাংস্কৃতিক পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। ৫৫ বছরের সংগীতজীবনে লালনের গানকে তিনি নতুন সুরে জনপ্রিয় করেছেন। তবে কিছু লালনভক্ত তার সুর দেওয়ার ধারা নিয়ে আপত্তি জানাতেন।