সিভিল এভিয়েশনে বহাল মেয়াদহীন ৪৩ পরামর্শক
পাচ্ছেন না বেতন-ভাতা, তারপরও ডিউটিতে
দেশের আকাশপথের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিভাগ বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন। এখান থেকেই বিমান চালানোর লাইসেন্স, পাইলটদের মেডিক্যাল নবায়ন, কারিগরি ছাড়পত্রসহ সব গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চলছে চুক্তিহীন ৪৩ পরামর্শকের ওপর নির্ভর করে। যাদের সবাই অনেক আগেই হারিয়েছেন বৈধতার কাগজ- তবু এখনও নিয়মিত সই করছেন ফাইলে, মতামত দিচ্ছেন এবং দায়িত্ব পালন করছেন বিনা বেতনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে মেয়াদোত্তীর্ণের হাতে আকাশপথ নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা দেশকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মফিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘বেবিচকের দক্ষ জনবল স্বল্পতার কারণে পরামর্শকদের দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। সরকারের অনুমোদনেই তাদের নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাদের চুক্তির মেয়াদ বাড়েনি। তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এটা অমানবিক। এখন পরিস্থিতি এমন যে, বেতন না দিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানোটাও তো আইনবহির্ভূত। এ জন্য যারা দায়িত্বে আছেন, নেতৃত্বে আছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
মফিদুর রহমান বলেন, ‘পরামর্শকরা অনেক প্রক্রিয়ায় নথিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। এখন যদি মন্ত্রণালয় তাদের চুক্তির আওতায় আনার ব্যাপারে দায়িত্ব না নেয়, তাহলে এখন পরামর্শকরা যেসব দায়িত্ব পালন করছেন, তার সব অবৈধ হয়ে যাবেন। এ নিয়ে পরবর্তীকালে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।’
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা হলেন সিনিয়র কনসালটেন্ট অ্যান্ড ফ্লাইট অপারেশন্স ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ-উজ্জ-জামান (অব.)। তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ১২ মে। একই তারিখে চুক্তি শেষ হয় সিনিয়র কনসালটেন্ট অ্যান্ড ফ্লাইট অপারেশন্স ইন্সপেক্টর গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) আশরাফুল আজহারের। গত মঙ্গলবার চুক্তি শেষ হয় বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) মাজেদ মিয়ার। স্পেশাল ইন্সপেক্টর গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এন. আই. এম ফেরদৌস হোসেনের চুক্তি শেষ হয় গত ৩০ আগস্ট। বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) মনিরুল হক জোয়ারদারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ১২ জুলাই। বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজ আব্বাসি রফিকেরও একই তারিখে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
এ ছাড়া বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) মোহাম্মদ ইলিয়াস মালিক ৩ সেপ্টেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) এম শফিউদ্দিন কামাল ৪ সেপ্টেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) আবুল কাশেম মো. মাহমুদুল হাসান ৫ সেপ্টেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক ক্যাপ্টেন (অব.) এম সফিকুল আজিম ৪ সেপ্টেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) গুলজার হোসাইন ১২ জুলাই, এভিয়েশন পাবলিক হেলথ ইন্সপেক্টর অ্যান্ড কনসালটেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রব মিয়া ৪ মার্চ, লিগ্যাল কনসালটেন্ট শুভ্র দে ২৮ জুলাই, এভিয়েশন অ্যাটর্নি ফারজানা নুসরাত গত বছরের ১০ ডিসেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক গোবিন্দ চন্দ্র বাড়ৈ ৩০ জুলাই, স্পেশাল ইন্সপেক্টর আসাদুল হক ৯ সেপ্টেম্বর, বিশেষ পরিদর্শক বেগম হুসনে খানম ১২ জুন, কনসালটেন্ট আবু কায়েস মো. জহিরুল ইসলাম ৪ মার্চ, জুনিয়র কনসালটেন্ট তারেক মুহম্মদ মুনিম ৩ জুন, বিশেষ পরিদর্শক আব্দুল ওয়াদুদ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর এবং বিশেষ পরিদর্শক আহমদ আরিফ সিরাজীর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ২৬ মার্চ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া অন্যান্য পরামর্শকের মধ্যে বেবিচকের এডব্লিউ বিভাগের বিশেষ পরিদর্শক তারিক সিরাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ১৩ জুন। জুনিয়র কনসালটেন্ট উম্মে ফারহা পিয়ার মেয়াদ শেষ হয় ৩১ মে এবং জুনিয়র লাইসেন্সিং কনসালটেন্ট সুমন রায়ের মেয়াদ শেষ হয় ১১ জুন। এ ছাড়া বেবিচকের পিইএল বিভাগের বিশেষ পরিদর্শক একেএম রেজাউল করিমের চুক্তির মেয়াদ ১২ জুন, সিনিয়র কনসালটেন্ট ক্যাপ্টেন (অব.) রাফিউল হকের ২৪ ফেব্রুয়ারি, সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. কর্নেল (অব.) আব্দুল খালেকের গত বছরের ৯ নভেম্বর, কনসালটেন্ট শাহ মোস্তফা আল মামুনের গত ২৯ মে, কনসালটেন্ট তোফাজ্জেল হোসেনের ২ জুন, কনসালটেন্ট ডা. এআইএম রফিকুল ইসলামের ৩১ জুলাই, কনসালটেন্ট ডা. আশরাফুল হকের ৪ জুন, কনসালটেন্ট লে. কর্নেল (অব.) হাবিবুল ইসলামের ২ জুন এবং কনসালটেন্ট ডা. মঈনুদ্দিন আহমেদের চুক্তির মেয়াদ গত ৩ জুন শেষ হয়।
এ ছাড়া এএনএস বিভাগের সিনিয়র ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আলী রেজা খানের চুক্তির মেয়াদ গত ৪ মার্চ, একই বিভাগের ইন্সপেক্টর রবীন্দ্র কুমার দাসের ৯ মে, কনসালটেন্ট শেখ একে রফিক আহমেদের ৪ জুন কনসালটেন্ট পরিতোষ কুমার হালদারের ৭ জুন, মেট ইন্সপেক্টর মঞ্জুরুল হক খানের ৪ মার্চ এবং কনসালটেন্ট ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় গত ৫ জুন।
বেবিচকের এজিএ বিভাগের কনসালটেন্ট তপন কান্তি ঘোষের চুক্তির মেয়াদ গত ৯ মে, জীবেশ চন্দ্র মুখার্জীর ৬ জুন এবং এটি বিভাগের বিশেষ পরিদর্শক মো. মোতাহার হোসেনের চুক্তির মেয়াদ ১ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। এ ছাড়া সিকিউরিটি ও অর্থ শাখায় চারজন কনসালটেন্টের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে বেবিচক সূত্রে জানা গেছে। তবে তাদের নাম জানা সম্ভব হয়নি।
বিমান পরিচালনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন শাখা অত্যন্ত গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখায় বহিরাগতদের দিয়ে কাজ করানোয় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের একজন সেবাগ্রহীতা আমাদের সময়কে বলেন, ‘মোটা অঙ্কের টাকা দিলেই এক দেড় মাসের ভেতর বিভিন্ন ফাইলের কাজ শেষ হয়ে যায়। টাকা না দিলে বছরের পর বছর ঘুরেও কাজ হয় না।
এদিকে বেবিচকের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বেবিচক কর্তৃপক্ষ সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পরামর্শকদের নিয়োগ দেয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) মেনে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ কারণেই এই ৪৩ কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।
এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ পরামর্শকদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইট সেফটি ও রেগুলেশন বিভাগের দায়িত্ব থাকায় দেশের আকাশপথের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করেন বেবিচকের সাবেক কর্মকর্তারা। চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়মিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লাইসেন্স অনুমোদন বাস্তবে প্রশাসনিক দায়মুক্তি এবং স্বচ্ছতার অভাবকে তুলে ধরে বলেও মত তাদের। একই সঙ্গে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি দেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
অবশ্য বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মুকিত-উল-আলম মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, আইকাওর মানদ-ে ঘাটতি নেই বলেই তারা কাজ করছেন। কারিগরি দিক থেকে তাদের কাজ করতে বাধা নেই। কিছু প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে, যেগুলো বেবিচক এবং মন্ত্রণালয় মিলে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।
এ বিষয় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ সাবেক বিমান পরিচালনা পরিষদের সদস্য কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগে দায়িত্ব পালনকারীদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দরকার। বিভিন্ন কারণে নিউইয়র্কে ফ্লাইট অপারেশন করতে পারছে না। তার মূল কারণ হচ্ছে ফ্লাইট সেফটি বিভাগের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অনিয়ম। তারা চারটি কন্ডিশন দিয়েছে। এ চারটি কন্ডিশন সিভিল এভিয়েশন ফুলফিল করতে না পারলে ক্যাটাগরি ওয়ানে উন্নীত হতে পারবে না। ওয়ানে উন্নীত হতে না পারলে কোনো এয়ারলাইন্সই নিউইয়র্কে ফ্লাইট অপারেট করতে পারবে না। কাজেই এটা কোনোভাবেই কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। যেভাবেই হোক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা কমপ্লাইয়েন্স থাকতে হবে। যদি তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, যদি সুযোগ থাকে তবে রিনিউ করতে হবে। না করা হলে বাদ দিতে হবে। একটা নিয়মের মধ্যে সমাধান করতে হবে। যারা নিয়ম মানার কথা তারাই নিয়ম ভাঙছে। যদি অনিয়ম হয়, তাহলে অন্যরা মানবে না। এ ক্ষেত্রে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে হয়।