লোকসানে টালমাটাল টেলিটক ধুঁকছে গ্রাহকহীনতায়

গ্রাহকহীনতায় টালমাটাল

এম এইচ রবিন
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
লোকসানে টালমাটাল টেলিটক ধুঁকছে গ্রাহকহীনতায়

বাংলাদেশের মোবাইল টেলিকম বাজারে একসময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অপারেটর টেলিটক। সেই অপারেটরটি আজ আর্থিক দুরবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকারি সুবিধা থাকলেও দুর্বল নেটওয়ার্ক, প্রযুক্তিগত দেরি আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ডুবে আছে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে টেলিটকের আয় ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ব্যয়ও ছিল কাছাকাছি। কিন্তু পরের বছরগুলোতে ব্যয় দ্রুত বাড়ে, থেমে যায় আয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় নামে ১ হাজার ২০০ কোটিতে। ব্যয় বেড়ে ছাড়ায় ২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর ৭০০-৮০০ কোটি টাকার লোকসান এখন নিয়মিত ঘটনা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট লোকসান দাঁড়ায় ১৭৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। নিরীক্ষক সংস্থাও টেলিটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

২০২৪ সালের জুনে টেলিটকের সক্রিয় গ্রাহক ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন। বাজারে তাদের অংশীদারত্ব ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিপরীতে গ্রামীণফোনের গ্রাহক ৮৫ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন, রবির ৫৯ দশমিক ৫১ মিলিয়ন আর বাংলালিংকের ৪৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন। 

টেলিটকের সিম ব্যবহারকারী চাঁদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কম দামে ইন্টারনেটের জন্য টেলিটক ব্যবহার করি। কিন্তু নেটওয়ার্ক প্রায়ই পাওয়া যায় না, অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে মারাত্মক সমস্যায় পড়ি। রাজধানীর ফকিরাপুল বাজারে কম্পিউটার দোকানদার শামীম ভূইয়া বলেন, সরকারি অনেক কাজে টেলিটক সিম বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেবার মান এত খারাপ যে লোকসান হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী।

২০০৪ সালে টুজি, ২০১২ সালে থ্রিজি আর ২০২১ সালে ফাইভজি ট্রায়ালের সুযোগ পেয়েছিল টেলিটক। কিন্তু সময়মতো প্রযুক্তি আপডেট করতে পারেনি। প্রতিযোগীরা এখন ফোরজি-ফাইভজিতে এগিয়ে গেছে। সেখানে টেলিটক এখনও পুরনো অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করছে।

টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টেলিটক শুধু মোবাইল অপারেটর নয়, এটি সরকারের কৌশলগত সম্পদও। তবে অকার্যকর বিনিয়োগ ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা আজ প্রতিষ্ঠানটির সংকট তৈরি করেছে। লোকসান কাটাতে হলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক প্রযুক্তি বিস্তার আর গ্রাহকসেবায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে।

সব দুরবস্থার পরও সরকার অবশ্য টেলিটককে এখনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মনে করছে। ফাইভজি পরীক্ষামূলক চালুর দায়িত্বও টেলিটক পেয়েছে। তবে আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

নরওয়ের টেলিনর আর মালয়েশিয়ার অক্সিয়াটা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থেকেও বিশ্ববাজারে লাভ করছে। অথচ তাদের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে (গ্রামীণফোন ও রবি) মুনাফা করছে। অন্যদিকে টেলিটক বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে। এ বিষয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, যেখানে বিদেশি রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে মুনাফা করছে, সেখানে আমাদের রাষ্ট্রীয় অপারেটর বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছেÑ এটা সম্পদ ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ ব্যর্থতা।

২০১৮ সালের জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিতেও সংস্কারের কথা বলা আছে। প্রতিযোগিতামূলক কৌশল, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বেসরকারি অংশীদারত্ব আর বিনিয়োগ আকর্ষণ ছাড়া টেলিটকের টিকে থাকা কঠিন।

মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান মর্ডর ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের টেলিকম বাজার হবে ৫ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার। ২০৩০ সালে তা দাঁড়াবে ৬ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে। এই বাজারে টেলিটকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সংস্কার, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সময়োপযোগী বিনিয়োগ জরুরি। নচেৎ টেলিটকের লোকসান কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নয়, বরং জাতীয় সম্পদের অপচয়ের প্রতীক হিসেবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে।