জেলে থেকেও অক্ষত ইয়াবা বদির সাম্রাজ্য

সরওয়ার আজম মানিক, কক্সবাজার
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জেলে থেকেও অক্ষত ইয়াবা বদির সাম্রাজ্য

আব্দুর রহমান বদি ফিরছেন- এমন আলোচনায় কক্সবাজারের টেকনাফে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে চলা ইয়াবা সাম্রাজ্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আলোচনায় আসা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি বর্তমানে কারাগারে। অভিযোগ উঠেছে, জেল থেকেই তিনি তার মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাইরে থাকা ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা তার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে। মূলত পরিবারের সদস্যদের পালিয়ে থাকা এবং নিজে জেলে থাকা সত্ত্বেও বদির মাদক সাম্রাজ্য অটুট থাকায় মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে ভয় কাজ করছে।

আব্দুর রহমান বদির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, ইয়াবা নামের মাদকের বিস্তার ঘটিয়ে তিনি দেশের প্রজন্ম ধ্বংস করেছেন। এ ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে- মাদক ব্যবসায় অর্জিত অর্থের জোরে স্থানীয় রাজনীতিতেও একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। প্রভাব খাটিয়ে দখলে নেন বহু মানুষের জমি। এর মধ্যে মেরিন ড্রাইভ সড়কের আশপাশে অনেক জমি রয়েছে। গড়ে তোলেন অঢেল সম্পদ। আলোচিত ওসি প্রদীপের সঙ্গে যোগসাজশ করে অনেক মানুষকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতেন। তবে বদির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ উঠলেও কার্যত তাকে থামাতে পারেনি কেউ।

ইয়াবা বাণিজ্য দিয়ে আলোচনায় : স্থানীয়রা জানায়, টেকনাফে ইয়াবা প্রবাহের সূচনালগ্ন থেকে আব্দুর রহমান বদি ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা প্রবেশ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বারবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তের সীমান্ত এলাকার সচেতন কয়েকজন নাগরিক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে মূলত ইয়াবা প্রবেশ করে আব্দুর রহমান বদির মাধ্যমে। মিয়ানমারের ওপারে থাকা ইয়াবা কারখানাগুলোতে আব্দুর রহমান বদির শেয়ার থাকার কথা জানিয়েছেন অনেকেই। বদির পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাদককারবারিরা বাংলাদেশে ইয়াবা নিয়ে আসে ।

টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসান সিদ্দিকী বলেন, আব্দুর রহমান বদি বাংলাদেশে ইয়াবা নিয়ে আসার মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পুরো একটি জাতি ধ্বংস করার জন্য তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সম্পৃক্ততা : বদির ভাই, শ্যালক এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা সরাসরি ইয়াবা-বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগের প্রমাণ বহুবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেয়েছিল। তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারিতেও রেখেছিল। কিন্তু বদির প্রভাবের কাছে কোনো চেষ্টা কাজে লাগেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আব্দুর রহমান বদির স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য শাহিন আক্তার, বদির ভাই আব্দুর শুক্কুর, আব্দুল আমিন, মৌলভী মুজিবসহ সবাই এলাকা ছাড়া। তার শ্যালক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীসহ সব শ্যালক ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক। তবে স্থানীয় মাদক ও চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকা-ের কলকাঠি এখনও তাদের হাতেই রয়েছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের টেকনাফ উপজেলার একজন প্রবীণ নেতা জানান, আব্দুর রহমান বদি সুযোগ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি মূলত আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধারণ করেন না। আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে উখিয়া-টেকনাফে যারা মনে-প্রাণে আওয়ামী লীগ করত, তাদেরকে নানাভাবে কোণঠাসা করে দলের নাম ব্যবহার করে ইয়াবা, দখল বাণিজ্য ও টেকনাফকে মাদকের সম্রাজ্যে পরিণত করে।

ওই নেতা বলেন, বদির স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার বাংলাদেশে থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে দেশের বাইরে আছেন বুঝিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মাঝে মাঝে সরব হয়ে ওঠেন। বদির ছেলে ছাত্রলীগ নেতা শাওন প্রায়ই সামাজিক মাধ্যম সক্রিয় থাকে এবং তার ভাই ও শ্যালকসহ সব আত্মীয়স্বজন মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

অঢেল সম্পদ : সাবেক সংসদ সদস্য বদি নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রাজনীতি ও অর্থবিত্তকে ব্যবহার করে তিনি টেকনাফের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন। মেরিন ড্রাইভের আশপাশে তার নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ রয়েছে বলে টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসান সিদ্দিকী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তদন্ত করে বের করে সমস্ত সম্পদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। যাদের জমি দখল করেছে, তাদের জমিগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে।

জমি দখল : অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফের সাবেক কমিশনার একরামের শ্বশুরের জমি দখল করে চৌধুরীপাড়া এলাকায় গাছের ওপর কটেজ বানিয়ে রেখেছে আব্দুর রহমান বদি। একরামকে হত্যার পেছনে এই জমি দখল একটি কারণ বলে মনে করে নিহত একরামের পরিবার। আর এই কটেজে বদি মাদকের আসর বসাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

টেকনাফ পৌর এলাকার বাসিন্দা মরহুম মৌলভী এজাহারের পুত্র মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের মার্কেটসহ পৌর এলাকায় ২ একর জায়গা আব্দুর রহমান বদির ইশারায় তার লোকজন দখল করে রেখেছে। আমরা অসহায়ের মতো আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি। আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই বদির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বা প্রতিবাদ করার। কারণ এখনও তার লোকজন উখিয়া-টেকনাফজুড়ে রয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফ পৌর এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আব্দুর রহমান বদি জেলে থাকলেও তার ক্যাশিয়ার ভগ্নিপতি ফারুক ও এনাম তার সমস্ত অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে বর্তমান বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও এ সীমান্ত মাদকবাণিজ্য বন্ধ হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

ওসি প্রদীপের সঙ্গে আঁতাত : সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে হত্যার অভিযোগে দ-প্রাপ্ত কক্সবাজারের সাবেক আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আব্দুর রহমান বদির। এ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বদি তার সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করেন? বলে অভিযোগ করেন টেকনাফের সাধারণ মানুষ। প্রদীপের ক্রসফায়ার আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে টেকনাফে বহু মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। আর সেই ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে পারেননি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, প্রদীপ-বদি আঁতাতই টেকনাফকে রক্তাক্ত করেছিল।

স্থানীয়রা বলছেন, ওসি প্রদীপ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আব্দুর রহমান বদির সহযোগিতায় তিনি মাদক নির্মূলের জন্য ক্রসফায়ার দিচ্ছেন। ওসি প্রদীপকে দিয়ে তার ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষসহ অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন টেকনাফের সাধারণ মানুষ। এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসান সিদ্দিকী বলেন, ওসি প্রদীপের সঙ্গে বদির ইন্ধনে যেসব হত্যাকা- হয়েছে, সেগুলোর পুনরায় নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।

কারাগার থেকেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ : গত বছরের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বর্তমানে কারাগারে থাকলেও বাদি সেখান থেকে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিজের ইয়াবা ব্যবসা, জমি দখল ও অর্থ লেনদেনের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ? সহযোগীরা এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে। ফলে কারাগারে থেকেও প্রভাব কমেনি বদির। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জেল থেকে বের হয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় আব্দুর রহমান বদি ফিরবেন- এমন সংবাদ দুই সপ্তাহ ধরে টেকনাফে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পুলিশের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, মাদকবাণিজ্য চালিয়ে নিতে তার সহযোগীরা এমন খবর ছড়িয়ে থাকতে পারে।

জন-অসন্তোষ ও আতঙ্ক : টেকনাফ উপজেলা ছাড়াও উখিয়া উপজেলা এবং আশপাশ এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বদিকে নিয়ে আতঙ্কের পাশাপাশি ক্ষোভও বিরাজ করছে। তারা বলেন, বদির পরিবার ও তাদের সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকাকে জিম্মি করে রেখেছে। কারাগারে থাকলেও তার প্রভাব অটুট থাকায় মানুষ এখনও আতঙ্কে রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও সীমাবদ্ধতা: র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশের একাধিক অভিযানে বিভিন্ন সময় বদির নাম এলেও সরাসরি প্রমাণের অভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে অনেকেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত কিংবা গ্রেপ্তার হয়েছে। তবুও ইয়াবা প্রবাহ কমেনি, বরং নিত্যনতুন কৌশলে অব্যাহত রয়েছে।

টেকনাফ থানার নবাগত ওসি আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নুর আমাদের সময়কে বলেন, তিনি যোগদানের পর থেকে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন- টেকনাফে যাতে কোনো প্রকার মাদক বিক্রি বা ব্যবহার না হয়, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এই নির্দেশনা মোতাবেক টেকনাফে কাজ চলছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আব্দুর রহমান বদির স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন আক্তারসহ তার একাধিক ভাই ও শ্যালকদের ফোনে করা হয়। তবে তাদের সবার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।