বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের শেষ কমিউনিস্ট

এহ্সান মাহমুদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের শেষ কমিউনিস্ট

গত কয়েক বছর বদরুদ্দীন উমরের জন্মদিন উপলক্ষে বেশ কয়েকটি ইন্টরভিউ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত ইন্টারভিউতে তার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতো। এসব ইন্টারভিউ পড়ে দেখা যেত নব্বই পেরিয়েও উমর সক্রিয় ছিলেন তার চিন্তা ও কাজে।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর কেন জরুরি সেটা তাকে ঘিরে আলোচনা ও লেখায় টের পাওয়া যেত। কেউ কেউ ভক্তি নিয়ে বন্দনা করতেন। আবার কেউ কেউ নিন্দা। তবে কেউ উমরকে অস্বীকার করতে পারেননি। যদিও উমর বলেছিলেন- দেশে তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা আবুল হাশিমের পুত্র, যার জন্ম বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

পেশাগত জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা থেকে শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। আবার ১৯৬৮-তে শিক্ষকতা ত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা উমর যখন নিজেকে উপেক্ষিত মনে করেন তখন সেটি যাচাই করে দেখতে ইচ্ছে করে! কেন উমর নিজেকে উপেক্ষিত মনে করছেন? উমর দেশের কাছে কী চেয়েছিলেন? ঠিক কী পেলে উমরের নিজেকে উপেক্ষিত মনে হতো না- এ বিষয়টি আলোচনা হওয়া দরকার। এ আলোচনার সময়ে মনে রাখতে হবে উমর যেখানে উপেক্ষিত হওয়ার কথা বলছেন- অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি উপেক্ষিত যদি হয়েও থাকেন সেটি তিনি কেন হলেন? তবে কি বাংলাদেশ পর্বে তিনি প্রবেশ করতে পারেননি? অথবা প্রশ্ন জাগতে পারে- স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে লড়াই সেখানে উমর কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন? এখানে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম দশকে যারাই সামনের দিকে ছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকে বাংলাদেশ জন্মের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে উমরের অবস্থান কোথায় ছিল? তাই উমর কিংবা তার মতো আরও অনেকেই নিজেকে উপেক্ষিত ভেবেছেন। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল- উমরের যে দল, এই দলটি স্বাধীন দেশে কী কী কর্মসূচি করেছে? যাদের মুক্তি দিতে চেয়েছেন, তাদের কাছে এই বার্তা কি পৌঁছানো গেছে? আবার যদি ভিন্নভাবে প্রশ্ন করি- উমর ঠিক কী পেলে নিজেকে উপেক্ষিত মনে করতেন না?

উমর যে রাজনীতি করেছেন বাংলাদেশে সেই রাজনীতি আসলে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল এই বাংলাদেশে? উমর নব্বই বছরে এসে বুঝলেন- ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের কোনো ভূমিকা নেই, ভবিষ্যৎও নেই।’ অথচ নিজের জীবনের পুরোটা কাটিয়ে দিলেন কমিউনিস্ট পরিচয় নিয়ে। তবে কি উমরকে আমরা বাংলাদেশের শেষ কমিউনিস্ট বলব?

বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুর পরে কয়েকজনকে দেখছি তিনি কী কী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন তার তালিকা করতে ব্যস্ত আছেন। ফিলিপস পুরস্কার, একুশে পদক, আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেননি। এ সকল পুরস্কার দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কেউ পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন, এটা তার চরিত্রের দৃঢ়তা। এটা কারও চরিত্রের গুণ হতে পারে না।

প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, বদরুদ্দীন উমর কেন জরুরি? উমরের লেখার কাছে আমরা কেন ফিরে যাব? দীর্ঘ সময় নিজের চিন্তায় অটল থাকা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শাসকশ্রেণির কাছ থেকে সুবিধা না নিয়ে উমর তার আসল ক্ষমতার পরিচয়টি দিয়েছেন। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন, দেশভাগ, সমাজ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার লেখার কাছে আমাদের ফিরতে হবে।

বদরুদ্দীন উমরের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ এই উপমহাদেশের রাজনীতির ভেতর বাড়ির খবর জানাতে সাহায্য করবে। পথিকৃৎ ইতিহাসবিদ হিসেবে উমর পাঠ জরুরি। বদরুদ্দীন উমর তার পাণ্ডিত্যের জন্য জরুরি আবার তার রাজনৈতিক দলের অকার্যকর অবস্থার জন্য উপেক্ষিত- এ সত্যটুকু মনে রাখা ভালো।

বদরুদ্দীন উমর জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমানে। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা ছিলেন। ১৯৫০ সালে তারা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন উমর। এখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবেও তিনি প্রথম দিকের একজন।

ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে সাহসী ও যৌক্তিক লেখাগুলো লিখেছিলেন, তা এখনও এই অঞ্চলের ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের’ পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ে আইয়ুব সরকারের দমন-পীড়নে উমর বুঝতে পেরেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি করে রাজনৈতিক চর্চা চালিয়ে যেতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন সেই সময়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। তবে কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থার কারণে সংস্কৃতি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি আবার প্রকাশ হয়েছিল।

বদরুদ্দীন উমর কেন এখনও প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছেন নিজেকে- এমন আলোচনা প্রায়ই শুনতে পাই। এই কথার সহজ উত্তর হতে পারে- এখনও তিনি সক্রিয় আছেন বলেই তিনি প্রাসঙ্গিক। উমর লিখেছেন দুই হাতে। সত্যিকার অর্থেই দুই হাতে তিনি লিখেছেন। উমরের পাঁচ খণ্ডে ‘আমার জীবন’ নামের প্রায় ১৫৫০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীর দিকে তাকালে তার লেখার ব্যাপ্তি বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। একবার আলোচনার মাঝে জানতে চেয়েছিলাম, আপনার এত দীর্ঘ কলেবরের আত্মজীবনী লেখার পেছনে উদ্দেশ্য কী? তিনি স্বভাবজাত ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘লেখার পেছনে আবার উদ্দেশ্য কী থাকবে? আমার যা জীবন, তা-ই লিখেছি। যাদের জীবনে কোনো ঘটনা নেই তারা কী বুঝবে! আমার কোনো লেখাতেই একটি বাক্যও অপ্রয়োজনীয় নয়।’ ২০১৯ সালে বের হয় তার আত্মজীবনীর পঞ্চম খণ্ড। এটা বের হওয়ার পর জানতে চেয়েছিলাম, সামনে আরও লিখবেন কিনা? বলেছিলেন, ‘আত্মজীবনী আর লিখব না। ওই পর্যন্তই থাকুক।’

তারপর আবার বললেন, ‘এখন যে দুঃসময় চলছে তাতে আত্মজীবনী লেখার চেয়ে অন্য লেখা আরও গুরুত্বপূর্ণ।’ বাংলা ভাষায় উমরের মতো আরও বিশাল পরিসরে আত্মজীবনী কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। রাহুল সাংকৃত্যায়ন পাঁচ খণ্ডে লিখেছেন ‘আমার জীবনযাত্রা’। সেটি প্রায় ২৮০০ পৃষ্ঠার।

উমর তার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছিলেন : ‘একজনের জীবন সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাসের কতটুকু ধারণ করে তার ওপরই নির্ভর করে এক একজনের আত্মজীবনীর মূল্য।’ আমরা যখন উমরের এ কথার পেছনের দিকে তাকাই তখন স্মরণ করতে পারি- উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে উমরের পরিবার এই অঞ্চলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই পরিবারে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট, কৃষক সংগঠক ছিলেন। আবার এই পরিবারে ছিল চাকরিজীবী ও জমিদার।

উমর দেখেছেন তার বাপ-দাদার কাছে এই উপমহাদেশের তথা সর্বভারতীয় অনেক নেতা আসা-যাওয়া করতেন। সেখান থেকে বিদেশে শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, সক্রিয় রাজনীতি, দেশভাগের ফলে নিজের পরিবারে সৃষ্ট জটিলতা; আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ডের জীবন, মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিতে না গিয়ে চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিতে যাওয়া, বাঙলাদেশ লেখক শিবির, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটি- এসবের দিকে তাকালে উমরের দীর্ঘ জীবনের অর্থপূর্ণ পরিণতি দেখা যায়।