বিমানের ভরাডুবির নেপথ্যে সাবেক মহাব্যবস্থাপক মিজানুর
বিমান বাংলাদেশের ভরাডুবিতে (আর্থিক ক্ষতি) সংস্থাটির তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (অর্থ বিভাগ) মিজানুর রশীদ ও ভারতের নাগরিক ভিনিত সুদ জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিমান বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ভারতের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সফটওয়্যার কেনা, বাজার দরের চেয়ে বেশি দর দেখিয়ে জ¦ালানি কেনা, চুক্তি ভঙ্গ করে বাড়ি ভাড়া উত্তোলন, নিয়মবহির্ভূত বোনাস উত্তোলন এবং বিমানের সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসসহ নানা অপকর্মে জড়িত এই সিন্ডিকেট। চক্রটির খপ্পরে পরে বিমানের হাজার কোটি টাকা গচ্চা গেছে বলে অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্থ প্রদানের ঘটনা শুধু আর্থিক অনিয়ম নয়, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিমালারও সরাসরি লঙ্ঘন। অভিযুক্ত দুজনের মধ্যে ভিনিত সুদ দেশে না থাকায় তার বক্তব্যে নেওয়া সম্ভব হয়নি। অপরদিকে মিজানুর রশীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বিস্তারিত লিখে তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অর্থ বিভাগের পরিচালক ছিলেন ভারতীয় নাগরিক ভিনিত সুদ। তিনি বিমানের আইটি বিভাগকে পাশ কাটিয়ে ভারতের একটি কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। ভিনিত নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই শুধু একটি খুদে বার্তার মাধ্যমে ভারতীয় কোম্পানির বিক্রয় বিভাগের প্রধানের সঙ্গে যোগসাজশ করে চলেন। বিমান বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই তিনি বিমানের নিজস্ব উদ্ভাবিত এক্সেল প্রোগ্রাম তুলে দেন ভারতীয় ওই প্রতিষ্ঠানের হাতে। যার ফলে ফ্লাইট প্রোফিটেবল সিস্টেম (এফপিএস) নামে ওয়েব-ভিত্তিক একটি সফটওয়্যার বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কেনা হয়। অথচ
সফটওয়্যারটির সব তথ্য ইনপুট দিতে হয় বিমানের কর্মীদের, আর আউটপুট আসে ঠিক সেই এক্সেল প্রোগ্রামের মতোই। শুধু তাই নয়, ‘ফাইন্যান্স বাজেট’ নামে আরেকটি অকেজো সফটওয়্যার ক্রয়ে বাধ্য করেন তিনি। এসব সফটওয়্যার থেকে ব্যবহারযোগ্য ফলাফল না থাকা সত্ত্বেও দুই বছরে ২৪ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা) গচ্চা দেয় বিমান। কোনো সফলতা না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে পুরনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই বাজেট প্রস্তুত করতে হয়েছে।
বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোটি টাকার লেনদেন
২০১৬ সালে বিমানের বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাসেলিয়া স্যুলিউশন লিমিটেডের কাছ থেকে ‘এফপিএস’ এবং বাজেট সফটওয়্যার কেনা হয়। এই অবৈধ কেনাকাটার পেছনে বিমান বাংলাদেশের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (অর্থ বিভাগ) মিজানুর রশীদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পায় বিমানের তদন্ত কমিটি। এভাবে মনগরা তথ্য উপস্থাপন করে ৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সফটওয়্যার কেনা হয় বলে জানা গেছে।
অকেজো প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আবারও ওই সফটওয়্যারের জন্য ২৪ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করে বিমান বাংলাদেশ। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবে বিমানকে বারবার আর্থিক ক্ষতির ফাঁদে ফেলেন মিজানুর রশীদ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পারফরমেন্স ছাড়াই বোনাস উত্তোলন
নিয়োগ চুক্তি অনুযায়ী ভিনিত সুদের বেতন-ভাতা বাংলাদেশি টাকায় প্রদানের কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তিনি চার দফায় ৯১ হাজার ৯৯২ মার্কিন ডলার ‘পারফরমেন্স বোনাস’ তোলেন। তার সময়ে কেনা সফটওয়্যারগুলো কাজে না লাগলেও কাগজে-কলমে সেগুলোকে ‘সফল’ দেখিয়ে এই অর্থ নয়ছয় করা হয়।
চুক্তি ভঙ্গ করে বাড়ি ভাড়া
নিয়োগ চুক্তিতে উত্তরায় বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও ভিনিত সুদ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে বাসা নেন। যার ফলে এই খাতে তিনি ৭২ লাখ টাকার বেশি নেন। পাশাপাশি বেতন ও ভাতা বাবদ নেন ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা এবং ট্যাক্স বাবদ নেন আরও এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিদেশ ভ্রমণের নামে বিমান থেকে আরও ২১ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
জ্বালানি ক্রয়ে নয়ছয়
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অভিযোগ রয়েছে, পদ্মা অয়েল কোম্পানির সঙ্গে আঞ্চলিক বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে জেট ফুয়েল ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করেন ভিনিত সুদ। বিমানের স্বার্থবিরোধী এই চুক্তি বোর্ডকে ভুল বুঝিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। পরবর্তী সময় তিনি এটিকেও ‘সফল চুক্তি’ আখ্যা দিয়ে পারফরমেন্স বোনাস নেন।
সংবেদনশীল তথ্য ভারতের প্রতিষ্ঠানের হাতে
ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনা সফটওয়্যারগুলোর মাধ্যমে বিমানের লাভ-ক্ষতি, যাত্রী সংখ্যা, টিকিট বিক্রির তথ্য নিয়মিতভাবে ভারতের প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হচ্ছিল। এভাবেই জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্যও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়। এফপিএস ছাড়াও আরএপিআইডি, এমবিএস, ভিরেদি নামের আরও কয়েকটি সফটওয়্যার কেনাকাটায় সরাসরি ভূমিকা রাখেন মিজানুর রশীদ।
আরএপিআইডি হলো বিমানের প্যাসেঞ্জার রেভিনিউ অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম। এটি প্রথমে অ্যাসেলিয়া কাইলি সুইজারল্যান্ড তৈরি করলেও বর্তমানে ভারতীয় সিন্ডিকেটের অধীনে চলছে। ২০১৩ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিমানের পক্ষ থেকে ছিলেন তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রশীদ। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে তিনি একই বিভাগে অবস্থান করে প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই ভারতীয় কোম্পানির কাছে সমর্পণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মিজানুর পরিবারের দুর্নীতি
মিজানুর রশীদের পরিবারও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ভাই হারুন-অর-রশীদ বিমানের অর্থ বিভাগে চাকরিকালে প্রায় ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি হয়ে বর্তমানে পলাতক।
বিমানের কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ভিনিত সুদ ও মিজানুর রশীদকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তা ছাড়া দুদকও এ বিষয়ে পৃথক তদন্ত শুরু করেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পিত এই দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই করেনি, বরং সংবেদনশীল তথ্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়ায় জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।