দলবদ্ধ সহিংসতা কাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ আইনশৃঙ্খলা
মব সন্ত্রাস বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার দলবদ্ধ সহিংসতা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কাটছে না বরং দিন দিন বাড়ছে। রাজনৈতিক ট্যাগ, চুরির অপবাদ, ধর্ম অবমাননাসহ আরও নানা অভিযোগ তুলে মব সৃষ্টি করে মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে; হেনস্তা করা হচ্ছে; ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি আইনের শাসনের ভয়াবহ বিপর্যয় এবং মানবাধিকারের সর্বোচ্চ লঙ্ঘন। গর্হিত এ অপরাধের বিরুদ্ধে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, রীতিমতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ পড়েছে বড় এক প্রশ্নের মুখে। দলবদ্ধ সহিংসতা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও হচ্ছে সমালোচিত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলবদ্ধ সহিংসতা এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এরই মধ্যে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নয়তো এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে শান্তিশৃঙ্খলা তথা সুষ্ঠু ভোটের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে। তারা আরও বলেছেন, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, দ্রুত বিচার সম্পন্ন না হওয়া, দোষীদের শাস্তি না হওয়ার জেরে দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ। আরও একটি কারণ নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, মব সহিংসতার মাধ্যমে সৃষ্ট আতঙ্ক মানুষকে নানা ধরনের উদ্বেগ-সংশয়ের মধ্যে ফেলছে। রাজনৈতিক বিভেদ, ধর্মীয় বা কোনো মতাদর্শকেন্দ্রিক বিরোধ ও ব্যক্তিগত পূর্বশত্রুতাসহ নানাবিধ কারণ ও প্রেক্ষাপটে অনেকেই নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছেন। এটি আইনের শাসনের সর্বোচ্চ বিপর্যয়, যা মানবাধিকারের সর্বোচ্চ লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া বিবৃতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রচলিত আইনের প্রেক্ষাপটে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মব সৃষ্টিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা লক্ষ্য করা গেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নানাভাবে বিতর্কিত হবে।
সম্প্রতি ঢাকা, রংপুর, চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলবদ্ধ হামলা বা সহিংসতার একাধিক ঘটনা দেশজুড়ে ভীষণ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, গত শুক্রবার একই দিন ঢাকা, রাজবাড়ী ও রাজশাহীতে পৃথক তিনটি দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও। গতকাল রবিবার তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতদিন যে রকম ছিল, গত কয়েক দিনের ঘটনায় আমি বলব- একটুখানি খারাপের দিকে গেছে। এটাকে আবার ‘পুরো আগের দিকে’ নিয়ে আসতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত শুক্রবার বিকালে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ইমাম মাহদী দাবি করা নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা দলবদ্ধ হয়ে নুরাল পাগলার দরবার ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় নূরা পাগলার অনুসারীরা তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করলে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ কা-ে নূরাল পাগলার এক অনুসারী নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ সময় পুলিশ-প্রশাসনের তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এ ঘটনার নেপথ্যে স্থানীয় কতিপয় রাজনীতিকেরও ভূমিকা ছিল।
একই দিন রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের পানিশাইল চন্দ্রপুকুর গ্রামে আজিজুর রহমান ভা-ারীর খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) উপলক্ষে ওই খানকায় তিন দিনের আয়োজন গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়। সেখানে ভা-ারি ও মুর্শিদী গান হচ্ছিল। শুক্রবার জুমার নামাজের পর হামলার শঙ্কায় সেখানে পবা থানার ওসির নেতৃত্বে দুই গাড়ি পুলিশও ছিল। কিন্তু দেড় শতাধিক উত্তেজিত জনতা যখন খানকা শরীফে হামলা-ভাঙচুর চালায়, তখন পুলিশ বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এ হামলার নেপথ্যেও স্থানীয় কিছু রাজনীতিকের ইন্ধন ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিছিল নিয়ে এসে দলবদ্ধভাবে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়, করা হয় অগ্নিসংযোগ। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেই জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এরও অনেক পরে অ্যাকশনে যায় পুলিশ।
গত ২৮ আগস্ট দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় ‘জীবন মহল’ নামের একটি বিনোদন পার্কে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে একজন সংবাদকর্মীসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় দুটি মাইক্রোবাস ও পাঁচ সংবাদকর্মীর মোটরসাইকেল। পরে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে দলবদ্ধ জনতা এ কা- ঘটায়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
গত ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চোর সন্দেহে প্রদীপ দাস ও রূপলাল দাস নামে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা সম্পর্কে জামাই-শ্বশুর। মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে রূপলাল ভাগনি জামাই প্রদীপকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। প্রদীপ নিজের ভ্যানগাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও উত্তেজিত জনতার দলবদ্ধ আক্রমণ দেখে ফিরে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, নিহতদের কেউই চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলবদ্ধ সহিংসতার বেশকিছু ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে। এ কারণে এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গিয়ে পুলিশ এক ধরনের সংকটের মুখে পড়ছে। শক্ত ব্যবস্থা নিলে যদি উল্টো বিপাকে পড়তে হয়- এ ভয়-শঙ্কা কাজ করে তাদের মধ্যে। ফলে দলবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার কঠোর বার্তা দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, দল-মত না দেখে মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যারাই সহিংসতা করবে, তাদেরই আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে, যেন তারাও এগিয়ে আসেন। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, সমাজে উগ্র আচরণ বেড়ে গেছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। দেশের প্রয়োজনেই এহেন কা- থামাতে হবে। অন্যথা গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য এটি বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। তিনি আরও বলেন, রাজবাড়ীতে যারা লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। এ ধরনের ঘটনা ইসলাম ধর্ম অনুমোদন করে না। পুলিশ ও প্রশাসন কেন এমন ঘটনা রোধে ব্যর্থ হলো, সেই কারণ উদ্ঘাটন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব কা-ের নেপথ্যে দেশি-বিদেশি ইন্ধন রয়েছে কি না, তাও খুঁজে বের করতে হবে বলে যোগ করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, অনেক সময় মব ভায়োলেন্স হঠাৎ এবং দ্রুতগতিতে ঘটে যায়। তাই এসব প্রতিরোধ করাটা কিন্তু অন্যরকমের এক চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত গুজবের বিস্তার এমন পরিস্থিতিকে আরও অনেক জটিল করে তোলে। তাই পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সম্মিলিত ভূমিকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধী শনাক্ত করা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদন বলছে, দেশে আগস্ট মাসে অন্তত ৩৮টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৩ জন নিহত ও ৪৩ জন গুরুতর আহত হন। জুলাই মাসে ঘটে ৫১টি। এতে নিহত হন ১৬ জন।
এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, আগস্ট মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন দুজন, আহত হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিকা- ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে গণপিটুনিতে ১০৩ জন নিহত ও ২৬৬ জন আহত হয়েছেন।