অনলাইনে জুয়ার ফাঁদ, নিঃস্ব হাজারও মানুষ

নিজস্ব প্রতেবেদক
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:০৪
শেয়ার :
অনলাইনে জুয়ার ফাঁদ, নিঃস্ব হাজারও মানুষ

যোগাযোগ-কেনাকাটা-লেনদেনসহ অনেক কিছুই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, জীবনকে করে তুলেছে গতিশীল। তবে এর কিছু বিপরীত দিকও আছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার কিছু মানুষের জীবনে ফেলেছে সর্বনাশের গাঢ় ছায়া। সেই সর্বনাশের অন্যতম একটি দিক হলো অনলাইন জুয়া। বাংলাদেশে আইনত জুয়া নিষিদ্ধ, তবুও তা অবাধে চলছে। বিশেষ করে অনলাইনে জুয়াখেলা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। প্রতারণার এই ফাঁদে হাজারো মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। একবার এই ফাঁদে পা রাখলে প্রলোভনের জাল ছিড়ে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন।

অনলাইনে জুয়া চলে সহজলভ্য অ্যাপসের মাধ্যমে। যে কেউ চাইলেই তার স্মার্ট ফোনে অ্যাপ আপ করে কিংবা ব্রাউজারে লিংক ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খুলে এই জুয়ার আসরে ঘরে বসেই যোগ দিতে পারে। এতে লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিং অর্থাৎ বিকাশ, নগদ বা রকেটের মাধ্যমে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বা এজেন্টদের পোস্টের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভের ফাঁদে ফেলতে সোশাল মিডিয়ায় ডেমো অ্যাকাউন্টে কয়েকগুণ বেশি লাভ দেখিয়ে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। লোভ দেখানো হয় লাখপতি হওয়ার! অ্যাপসগুলোতে এমনভাবে সফটওয়ার সাজানো থাকে, যাতে শুরুতে হয়তো সামান্য লাভ পাওয়া যায়। পরে আরো লাভের আশায় যখন কেউ আরও টাকা বিনিয়োগ করে তখনই শুরু হয় লুটে নেওয়া। হারানো টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় আরো খেলতে গিয়ে মানুষ আরো বিপদে পড়ে। একসময় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। 

অনেকেই কৌতূহল থেকে এ খেলা শুরু করার পর এতে এমনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছেন যে, আর বের হতে পারেন না। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, মানসিক বিষণ্নতা, দাম্পত্য জীবনে কলহ। খেলার টাকা জোগাড় করতে বাড়ছে অপরাধ। বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয়। এই সর্বনাশা অনলাইন জুয়ার নেশায় বিপন্ন পরিবার, সমাজ—এমনকি রাষ্ট্র।

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্ম। অবশ্য বয়স্কদেরও এখন এই খেলা খেলতে দেখা যায়। এমনকি গ্রাম এলাকার অনেক শ্রমজীবীমানুষ তাদের মজুরিটুকুও এই পথে নষ্ট করছেন।লোভে পড়ে লাভের আশায় অনেকে ধারকর্জ করছেন, নিজের শেষ সম্বল জমিটুকুও বিক্রি করে দিচ্ছেন। পরে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনলাইন জুয়ার আসক্তি মাদকের আসক্তির চেয়েও প্রবল ও ক্ষতিকর। 

অনলাইনে জুয়া দেশের জন্যও হয়ে ওঠেছে মারাত্মক অশনিসংকেত। কারণ এইসব সাইটের সফটওয়্যারসহ মূল মালিকানা থাকে বিদেশিদের হাতে। বিশেষ করে চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে অনলাইনে জুয়ার সাইটগুলো পরিচালিত হয়। দেশে কিছু এজেন্ট তাদের সহায়তা করে থাকে।অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে অধিকাংশরাই নিঃস্ব হয়ে যায়। তবে এসব সাইট পরিচালনার মূলহোতা ছাড়াও লাভবান হচ্ছে দেশ থেকে যুক্ত থাকা এজেন্টরা। মূলত: জুয়া খেলায় দক্ষ হয়ে উঠা ও এসব প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া ব্যাক্তিরা সাইটগুলোতে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এজেন্ট একাউন্ট নেয়। এরপর অবৈধ কারেন্সি বিভিন্ন অংকে বিক্রি করাসহ জুয়া বিস্তারে তারাই ভূমিকা রাখছে বেশি।

এসব এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রিচার্জ করা টাকা অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। অনলাইন জুয়ায় বিদেশে পাচার হচ্ছে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্খ।এই অনলাইন জুয়ার আগ্রাসন রুখতে না পারলে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে দেশে। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে এ বিষয়ে তৎপর হয়েছে। বিটিআরসির রিপোর্ট অনুযায়ী, সম্প্রতি ৩৩১টি জুয়ার সাইট দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বন্ধ করাটাও কার্যকর থাকছে না। কারণ প্রতারক চক্র প্রতিটি অ্যাপস বা সাইটে বিকল্প কয়েকটি আইপি ব্যবহার করে থাকে। একটা বন্ধ হলে আরেকটা আইপি দিয়ে বা নাম পরিবর্তন করে তারা নতুনভা্বে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে দরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান এবং কঠোর নজরদারি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, তারা অনলাইনের জুয়ার বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছেন।। কিন্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পর খুব দ্রুতই তারা জামিনে বেরিয়ে পরে। এরপর তারা আবার গড়ে তুলে জুয়ার সাইট। তারা বের হয়ে আবার বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। কেউ নাম বদলে আবার সাইট চালু করেছে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এর ধারাবাহিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৮ মামলায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের প্রায় সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

এদিকে সাইবার পুলিশ সেন্টারে ৩ জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে পৃথক ৪টি মামলার তদন্ত চলছে। ওয়ানএক্সবেট এর দুই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬ জনকে। তারা এই সাইটের এজেন্ট, হুন্ডিসহ বিভিন্ন স্তরে কাজ করতেন। একইভাবে মোস্টবেট এর ৮ জন, বেটবাজ৩৬৫ এর ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিবির-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ এখন পর্যন্ত একটি মামলা নিস্পত্তি করেছে। শিলং তীর নামে ওই অনলাইন জুয়ার সাইটের সাথে জড়িত ৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৩টি মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অনলাইন জুয়া বন্ধে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার. সেটা হলো জনসচেতনতা। সামাজিকভাবে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে, জুয়ার ক্ষতিকর নানাদিক। কিভাবে এটি মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, তা তুলে ধরতে হবে। ঘরে ঘরে ব্যাপক সচেতনতা আর সরকারের কঠোর তৎপরতায় নির্মুল করা সম্ভব অনলাইন জুয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন।

এ বিষয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞ ও ডিকোডস ল্যাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন, প্রযুক্তির এ যুগে আপনি চাইলেই এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। ব্যক্তিপর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরি ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কারণ, এসব জায়গায় বিনিয়োগ করা খুবই সহজ। শুরুতে অল্প টাকা দিতে হচ্ছে। যেমন- আপনি ২০ থেকে ১০০ টাকা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলা শুরু করতে পারেন। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এগুলো মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে। গ্রামাঞ্চলের একেবারে নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিরাও এতে জড়িয়ে পড়ছেন, যা খুবই ভয়াবহ।

তিনি বলেন, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি পাঠ্যক্রমেও এসব বিষয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে। আর দেশে যারা এসব কার্যক্রম ছড়র ক্ষতিকর নানাদিক। কিভাবে এটি মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, তা তুলে ধরতে হবে। ঘরে ঘরে ব্যাপক সচেতনতা আর সরকারের কঠোর তৎপরতায় নির্মুল করা সম্ভব অনলাইন জুয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন।