পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারের অভাব
দেশের শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির অভাব রয়েছে। এ ছাড়া স্বচ্ছতার অভাব ও দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহির অভাবে বিকশিত হচ্ছে না শেয়ারবাজার। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ২৭.২২ শতাংশ কোম্পানিই এখন দুর্বল মানের। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৬০টি কোম্পানির মধ্যে ৯৮টি জেড ক্যাটাগরির। দুর্বল মানের এসব কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। জেড শ্রেণিভুক্ত দুর্বল মানের কোম্পানিগুলো জাঙ্ক শেয়ার হিসেবেও পরিচিত।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যে হারে জাঙ্ক বা জেড শ্রেণিভুক্ত শেয়ারের সংখ্যা বাড়ছে, তা বাজারের জন্য উদ্বেগজনক। দুর্বল মানের এসব কোম্পানি নিয়ে হামেশা কারসাজির ঘটনাও ঘটছে। নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে এসব শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। এতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
অন্যদিকে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতি চারটি কোম্পানির মধ্যে একটির শেয়ার তার অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে, যার মূল কারণ ওই সব কোম্পানির দুর্বল পারফরম্যান্স। এই তালিকার শীর্ষে আছে খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানো মিউচুয়াল ফান্ড এবং কিছু বস্ত্র খাতের কোম্পানির শেয়ারও এই তালিকায় রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, শেয়ারবাজারের এমন দুর্বল অবস্থা স্থানীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীদের কাছেই আকর্ষণ হারাচ্ছে। তাদের মতে, বাজারে শক্তিশালী কিছু কোম্পানি থাকলেও সংখ্যায় খুবই কম। তাই বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু ওই সব প্রতিষ্ঠানের দিকেই ঝুঁকছেন, যেগুলোর পারফরম্যান্স ভালো। বিশ্লেষকরা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এই সংকট সমাধানে দুর্বল কোম্পানিগুলো বন্ধ বা একীভূত করা এবং বাজারে নতুন ও শক্তিশালী কোম্পানি আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
ভালো শেয়ার তালিকাভুক্তির উদ্যোগ : দীর্ঘদিনের ভালো শেয়ারের ঘাটতি কাটাতে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এবার সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বহু প্রতীক্ষিত চাহিদা পূরণ হতে যাচ্ছে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পুঁজিবাজারে দেশি ও বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে চায়, কারণ এটি প্রতিযোগিতামূলক ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করবে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এবং লাভজনক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পুঁজিবাজারে আনা হবে, যা বাজারে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং সামগ্রিকভাবে বাজারকে বড় করতে সাহায্য করবে। দেশি-বিদেশি বড় কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে আইনি বাধ্যবাধকতা আনতে যাচ্ছে বিএসইসি। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্তির আওতায় আনতে বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা শুরু করেছে সংস্থাটি।
গত ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশি ও বিদেশি বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনতে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনার আলোকে এবার শক্তিশালী আইনগত কাঠামো গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংস্থাটির মতে, স্বেচ্ছায় তালিকাভুক্ত হতে অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী নয়। আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি হলে তাদের বাজারে আসতেই হবে। বহু দেশেই বড় প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বর্তমান ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন (এফআরএ) অনুযায়ী, ‘জনস্বার্থ সংস্থা’ বলতে বোঝায় ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিএসইসিতে প্রতিবেদন দাখিলকারী প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা এবং নির্দিষ্ট সীমার বেশি সম্পদ, রাজস্ব বা দায়সম্পন্ন কোম্পানি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) নির্ধারিত মানদ- অনুযায়ী- বার্ষিক রাজস্ব ৫০ কোটি টাকা, মোট সম্পদ ৩০ কোটি টাকা এবং মোট দায় ১০ কোটি টাকার মধ্যে যে কোনো দুটি শর্ত পূরণ করলেই প্রতিষ্ঠানকে জনস্বার্থ সংস্থা হিসেবে ধরা হবে। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এই তালিকার আওতাভুক্ত।
উল্লেখ্য, সরকারি মালিকানাধীন ও সরকারের শেয়ার রয়েছে- এমন ৩৬টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে সেগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালের মধ্যে শেয়ার ছাড়ার আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। শেষে যৌথ মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ৩৪টির মধ্যে সরকারি ২৬টি কোম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত ১৭ বছরে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা মেনে পুঁজিবাজারে আসতে ব্যর্থ হয়েছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। মূলধন সংকটে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু শেয়ার আপলোডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বছরের পর বছর ধরে গড়িমসি করেছেন এসব কোম্পানিতে থাকা সরকারি আমলা ও পরিচালকরা। বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি এড়াতে অনেক সময় কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ধরনা দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। তবে এবার খোদ সরকারপ্রধান নির্দেশনা দেওয়ায় আশার আলো দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করছেন, আমলাতন্ত্রের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে সরকারি কোম্পানিগুলো এবার শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হবে।
জানা গেছে, যে পাঁচটি কোম্পানি শেয়ার ছাড়তে পেরেছে সেগুলো হলো- যমুনা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও রূপালী ব্যাংক। শেয়ার ছাড়ার জন্য নির্দেশিত বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১১টি; ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিনটি এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি করে কোম্পানি রয়েছে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে ভালো শেয়ারের অভাব রয়েছে। ৫ বছর আগেও যেসব শেয়ার ভালো ছিল, সেগুলোও আজ মন্দ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা সরকারি লাভজনক শেয়ার তালিকাভুক্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে ভালো কোম্পানি। এসব কোম্পানিকে সরাসরি দ্রুত তালিকাভুক্তির পরামর্শ দেন তিনি।