নারীবিদ্বেষী প্রার্থী ও দলকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:১৭
শেয়ার :
নারীবিদ্বেষী প্রার্থী ও দলকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান

গত এক বছরে বেড়েছে নারীবিদ্বেষ। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক সমাবেশ করা হলো। এ অবস্থায় নারীবিদ্বেষী প্রার্থী ও দলকে যেন কেউ ভোট না দেন, তাদের সঙ্গে কেউ যাতে জোট না বাঁধে, তা নিয়ে প্রচার চালানো আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। ৭১টি সংগঠন নিয়ে গঠিত সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

গতকাল বুধবার আর্ন্তজাতিক সিডও দিবস উপলক্ষে ‘সংসদে নারীর কার্যকর ও ফলপ্রসূ প্রতিনিধিত্ব: সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি নির্বাচন’ শিরোনামে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।

বক্তারা বলেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারী প্রতিনিধিত্বহীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও নারী আসন নিয়ে একক কোনো প্রস্তাব হাজির করতে পারেনি। একের পর এক প্রস্তাব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঐকমত্য কমিশন জাতীয় সংসদে নারী আসন সংরক্ষণ বিষয়ে ‘নাটক’ করেছে।

আলোচনায় বক্তারা জাতিসংঘের ‘নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ’ বা সিডও সনদের দুটি ধারা ২ ও ১৬ (গ)-এর ওপর বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানান। তারা সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চান।

সভা সঞ্চালক বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, এখন নতুন সংকট দেখা দিয়েছে—নারীবিদ্বেষী মনোভাব। এসব বিদ্বেষ সামনে আনা হচ্ছে নারীকে ভয় দেখিয়ে পশ্চাৎমুখী করে রাখার জন্য।

তিনি আরও বলেন, সিডওর ওই দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার না হওয়ায় নারীর পারিবারিক, বিবাহসংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

ধারণাপত্র উপস্থাপনে বেসরকারি সংগঠন ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, একটি গণতান্ত্রিক, সমতাপূর্ণ সমাজকাঠামো তৈরি করতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর সম–অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। সংসদে মোট আসন ৪৫০ করা এবং এর মধ্যে ১৫০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। দুটি সাধারণ আসন নিয়ে একটি সংরক্ষিত আসন করতে হবে। সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন প্রথা বাতিল করে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোট হতে হবে। এ ব্যবস্থা সংসদের দুই-তিন মেয়াদের জন্য বলবৎ থাকবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, কমিশন জানিয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ১০০ আসনে উন্নীত করার জন্য বিধান করা হবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংরক্ষিত আসন ৫০টি বহাল রেখে সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষরের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য রাজনৈতিক দলকে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত নারী প্রার্থী মনোয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। ২৬টি দল ও জোট এতে একমত। নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছে আমজনতার দল, সিপিবি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।

তিনি বলেন, ‘আমরা ওই প্রস্তাব মানিনি। আমরা বলেছি, এ ধরনের আলোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন চাই। একের পর এক প্রস্তাব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় সংসদে নারী আসন সংরক্ষণ বিষয়ে নাটক করেছে। অনেক প্রস্তাবে স্থির থাকলেও সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচনে অনড় থাকেনি। সর্বশেষ যা প্রস্তাব করেছে, সেটি মানার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচনকে এক অর্থে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নারীরা যদি বলতেন, এসব দাবি না মানা পর্যন্ত তারা ভোট দেবেন না, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো দাবি মানতে বাধ্য হতো। নারীদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দাবি বাস্তবায়নে অনেক দল একমত হবে না। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে স্মারকলিপি জমা দিতে হবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ঐকমত্য কমিশনে নারীদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই। গত এক বছরে নারীবিদ্বেষ বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এক নারীকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। নারীদের অবমাননা করছেন, এমন দল ও প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এটাকে সামাজিক দাবি হিসেবে প্রচার করতে হবে।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন নারী আসন নিয়ে একক কোনো প্রস্তাব দলগুলোর সামনে হাজির করতে পারেনি। আমরা সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চেয়েছি। বিদ্যমান পদ্ধতিতে স্ত্রী, কন্যা, শ্যালিকারা সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পায়। সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন না হওয়ায় জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হয় না।’

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি বলেন, ২০২৫ সালে এসেও নারীকে ভাবতে হয় তিনি মনোনয়ন পাবেন কি না, যা খুবই দুঃখজনক। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রচলিত রাজনৈতিক পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতান বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পর নারীর জন্য ৫ শতাংশ মনোনয়ন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হওয়া অসম্ভব। সংসদে এখন ৫০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। ১৫ সেপ্টেম্বর ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আশা করি, তারা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।

গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম এ সবুর, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের প্রতিনিধি দিলীপ সরকার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সাবেক কর্মকর্তা নাজরানা হক হীরা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমী, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিপিকা তাপসী, দলিত নারীগোষ্ঠীর প্রতিনিধি তামান্না সিং বড়াইক, ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শ্বাশতী বিপ্লব প্রমুখ।