এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একঘেয়ে জীবন
দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে একঘেয়ে কর্মজীবনে আটকে রয়েছেন। বদলির অভাবে শিক্ষকরা জীবনের বড় অংশ একই বিদ্যালয়ে কাটাচ্ছেন। ফলে পেশাগত উদ্দীপনা কমছে এবং শিক্ষার্থীরাও সমান শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শহরে শিক্ষকের ভিড়, গ্রামে শূন্যপদ- এই বৈষম্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বচ্ছ, অনলাইন ও প্রয়োজনভিত্তিক বদলি নীতিমালা চালু হলে শিক্ষকরা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন এবং শিক্ষার্থীরাও শহর-গ্রামের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই সমান শিক্ষা উপভোগ করতে পারবেন।
বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। বর্তমানে দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী সরকারের নির্ধারিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। অথচ তাদের জন্য কার্যকর বদলিনীতি চালু হয়নি। বদলির অভাবে একঘেয়ে জীবন কাটে। সরকারি চাকরিজীবীরা যেখানে বদলির সুযোগ পান, সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আজীবন একটি বিদ্যালয়েই আবদ্ধ থাকেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. রাশেদা পারভীন মনে করেন, এর ফলে শিক্ষকদের ক্যারিয়ার একঘেয়ে হয়ে পড়ে, জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয় এবং শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তার মতে, যদি বদলি চালু হয়, শিক্ষকরা পেশাগত ও সামাজিকভাবে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও একই সুরে কথা বলেছেন। রাজধানীর মতিঝিলের একটি স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মতিউর রহমান বলেন, ‘গ্রামের বিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের ঘাটতি প্রকট। বদলি চালু হলে শিক্ষার মান ও বিস্তার দুটোই বাড়বে। শহর-গ্রামের বৈষম্যও কমবে।’
বদলির সম্ভাব্য প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, বদলি কার্যকর করার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা জরুরি। সম্ভাব্য প্রক্রিয়া হতে পারে- আবেদনভিত্তিক বদলিতে শিক্ষকরা নির্দিষ্ট সময়ে অনলাইনে আবেদন করবেন। মিউচুয়াল বদলিতে দুই শিক্ষক পারস্পরিক সম্মতিতে পরস্পরের স্কুলে যেতে পারবেন। প্রয়োজনভিত্তিক বদলির ক্ষেত্রে কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট হলে সরকার ওই পদে অন্য বিদ্যালয় থেকে বদলি করাতে পারবে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় জেলা শিক্ষা অফিসারদের তত্ত্বাবধানে বদলিপ্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা।
এই প্রক্রিয়াগুলোর পথে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান দক্ষ শিক্ষককে হারাতে চাইবেন না। একই সঙ্গে অনেক শিক্ষক পরিবার ও সন্তানদের পড়াশোনার কারণে শহরে থাকতে চাইবেন, এতে গ্রামীণ বিদ্যালয় শূন্য হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া, আইনগত ঘাটতিও বড় চ্যালেঞ্জ। পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা না থাকলে মামলা ও প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, স্বচ্ছ ও কার্যকর বদলি ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষা খাতে নতুন যুগের সূচনা হবে। তবে সফলতার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।
বদলি প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সুপারিশ করেছেন- স্বচ্ছ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম করতে হবে। অনলাইন বদলি ব্যবস্থা করলে দুর্নীতি ও অনিয়ম কমবে। জেলা কোটা নির্ধারণ করে প্রতিটি জেলায় শিক্ষক সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে বদলি সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা বোর্ডের নজরদারির মাধ্যমে বদলি অনুমোদনে বোর্ড ও অধিদপ্তরের যৌথ কমিটি থাকতে হবে। বদলিনীতি সংস্কার আইন করে বদলিকে বাধ্যতামূলক কাঠামোতে আনা দরকার, যেন মামলা বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকানো যায়।
চট্টগ্রামের একটি কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমাদের কলেজে প্রবীণ ইংরেজি শিক্ষক আছেন। ঢাকায় পরিবার থাকায় তিনি প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বদলি থাকলে সহজেই ঢাকায় যেতে পারতেন। তবে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর স্বার্থও নীতিমালায় স্পষ্টভাবে রাখতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান জানান, বদলিসংক্রান্ত নীতিমালার খসড়া এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন। তার ভাষায়, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বদলিপ্রক্রিয়া চালু করা। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নিয়ে ধীরে এগোতে হবে।’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে এক সভায় এমপিওভুক্ত সব শিক্ষককে বদলির আওতায় আনার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেওয়া হয়েছে। সভাসূত্রে জানা গেছে, আইনি জটিলতা এড়াতে সর্বজনীন বদলির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা হচ্ছে। তবে প্রায় ৪ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য সংগ্রহ করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বদলি না থাকায় একজন শিক্ষককে জীবনের শেষ পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে থাকতে হয়। বদলি চালু হলে গ্রামীণ বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষক পাওয়া সহজ হবে। শিক্ষকরা নতুন অভিজ্ঞতা ও উদ্দীপনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ সমৃদ্ধ করবেন।
২০২৩ সালের জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৩৯ হাজার ৯২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ছিল। এর মধ্যে কলেজ ৪ হাজার সাতটি, মাধ্যমিক স্কুল ১৯ হাজার ৮৪৮টি, মাদ্রাসা ৯ হাজার ৩৪১টি এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৮৯৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংখ্যা ছিল যথাক্রমে- কলেজে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৩৭ জন, মাধ্যমিকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন, মাদ্রাসায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৮ জন এবং কারিগরিতে ৩২ হাজার ৩৭৮ জন।
বদলিনীতি চালু হলে শিক্ষকরা যেমন পেশাগত স্বস্তি পাবেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও সমান শিক্ষা অধিকার ভোগ করতে পারবে। শহর-গ্রামের বৈষম্য দূর হয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ নীতি, আইনগত সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রক্রিয়া।