আমানত ও ঋণের সুদ ব্যবধান অস্বাভাবিক
ব্যয়বহুল হচ্ছে ব্যাংক ঋণ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
দেশের ব্যাংক খাতে আমানত ও ঋণের সুদের পার্থক্য (স্প্রেড) অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কিছু ব্যাংকের স্প্রেড ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সার্বিক খাতে এ ব্যবধান প্রায় ৬ শতাংশ। এটি পার্শ্ববর্তী যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আমানতে কম সুদ দিচ্ছে, কিন্তু ঋণের ওপর চাপাচ্ছে বেশি সুদ। এতে ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকার্স সভায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণের উচ্চ সুদ শুধু ব্যবসায়ী নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য হুমকি। এতে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের যে হারে সুদ বা মুনাফা দেয় এবং ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে যে হারে সুদ নেয়, এ দুই হারের পার্থক্যই হলো সুদ ব্যবধান বা স্প্রেড। সাধারণত ৩ শতাংশ স্প্রেড স্বাভাবিক ধরা হয়। বিশ্বব্যাপী এ হার ২ থেকে ৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এটি দ্বিগুণেরও বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- বাজারভিত্তিক সুদহার চালু হওয়া, স্প্রেড সীমা তুলে নেওয়া, নীতি সুদহার বৃদ্ধি, বেশি খেলাপি ঋণ, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ ও অতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতা।
২০২৪ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পরিপালনে সব ধরনের ঋণের সুদ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে স্প্রেড সীমাও তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকেই ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে সুদহার নির্ধারণ করছে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণের সুদ ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে উঠেছে। দেড় বছরেরও কম সময়ে বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। এতে ছোট-বড় সব খাতের ব্যবসায়ীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ঋণের কিস্তির অঙ্কও বাড়ছে। এমনিতেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। এ অবস্থায় ক্রমাগত সুদহার বৃদ্ধিতে চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, এখন ব্যাংকগুলো ৫ থেকে ৮ শতাংশ স্প্রেড করছে। যা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। পার্শ্ববর্তী দেশে স্প্রেড ৩ শতাংশের নিচে। এ কারণে গভর্নর বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন এবং ব্যাংকগুলোকে সহনীয় পর্যায়ে আনার নির্দেশ দেন। গভর্নরের এই নির্দেশনার পর ওই মাসেই ব্যাংক খাতে গড় স্প্রেড কিছুটা কমে আসার তথ্যও মিলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে এখনও ১৮টি ব্যাংকের স্প্রেড ৬ থেকে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি ১০টি, সরকারি ১টি ও বিদেশি ৭টি ব্যাংক আছে। সবচেয়ে বেশি স্প্রেড ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে। তারা ঋণ দিয়েছে গড়ে ১৬ দশমিক ৬০ শতাংশে, কিন্তু আমানত নিয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ সুদে। দ্বিতীয় স্থানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, যেখানে স্প্রেড ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের স্প্রেড সবচেয়ে বেশি- ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদ নিয়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আমানত সংগ্রহ করেছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ফলে ব্যাংকটির স্প্রেড দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পর থেকে ব্যাংকগুলোই তা নির্ধারণ করছে। যদি কোনো ব্যাংক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে, তবে সেই ব্যাংকের সুদের হারও বেশি হয়। বিপরীতভাবে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারলে সুদের হারও তুলনামূলক কম হবে। তবে সুদের হার বেশি হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়গুলো দায়ী।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কোনোভাবেই স্প্রেড ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। আমাদের দেশে এটা বেশি হওয়ার কারণেই ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। এখন ১৫-১৬ শতাংশ সুদের হার উঠেছে। এই সুদের হারে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন। যার কারণে বহু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখানে দ্রুত হস্তক্ষেপ করা উচিত। ঋণ শ্রেণিকরণ সার্কুলারে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রহিত করা উচিত।