যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা তাদের বিপক্ষে
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি
মাহমুদুর রহমান মান্না। দেশের সমকালীন পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান সরকারের মূল্যায়নসহ নানা বিষয়ে দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন দৈনিক আমাদের সময়ের স্টাফ রিপোর্টার মুহম্মদ আকবর-
আমাদের সময় : নির্বাচনী রোডম্যাপ হলো। ডিসেম্বরে তফসিল, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। দেশের সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদ?
মাহমুদুর রহমান মান্না : নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এখানে নিরাশ হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। চ্যালেঞ্জ থাকলে মোকাবিলা করে যেতে হবে। তবে আমি অভ্যন্তরীণভাবে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না। সংস্কার নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নতা থাকতেই পারে, আছেও। এটা সমাধান করেই এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে তো মার্শাল ল’ হতে হবে। এটা কি হচ্ছে? আমি তো মনে করি নির্বাচন হবে।
আমাদের সময় : কিছু রাজনৈতিক দল এখনও বলছে যে, তারা এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। সংস্কার শেষ না করে নির্বাচন নয়। ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে, এটা সম্ভব?
মাহমুদুর রহমান মান্না : শুরুর দিকে আমরা অনেকে অনেক কথা বলেছি। আমরা তো অনেকে ভালো করে সংস্কারটাই বুঝিনি। আমরা কোয়ালিটি নির্বাচন চাচ্ছি সেটাও বুঝিনি। পিআর না গণপরিষদ নির্বাচন করতে হবে? এগুলোরও নিষ্পত্তি হবে। তবে এসব বাদ দিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে। পরে এসব ঠিকঠাক করব। এই বিতর্ক নিষ্পত্তি করেই আমরা সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পর্যন্ত সেভাবে আসছি। পরিস্থিতি কোথাও আটকে গেছে এ রকম আমার মনে হচ্ছে না। ভবিষ্যতে কি আটকাতে পারে? যদি আটকায়ও, আমি মনে করি সেটার সমাধান করে এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের সময় : এখন পর্যন্ত তো শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ডাকসুর মতো নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী থেকে বলা হয়েছে- তারা এখানে দায়িত্ব পালন করবে না। কী মনে হচ্ছে আপনার?
মাহমুদুর রহমান মান্না : ডাকসু ইলেকশনে সেনাবাহিনী দিতে হবে কেন? সেনাবাহিনী গুলি করবে নাকি? যদিও পরে আইএসপিআর থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে যে তারা এই দায়িত্ব পালন করতে যাবে না। তবে এটা দেখে জাতীয় নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে- এমন কিছু আমি মনে করছি না। ডাকসু ইলেকশনে গোলযোগ ১৯৭৩ সালে হয়েছিল। ভোট বাক্স ছিনতাই হয়ে গেছিল। এটা হতে পেরেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আমাদের সময় : ডাকসু নির্বাচনকেন্দ্রিক সামগ্রিক একটা মূল্যায়ন আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। যেমন কয়েকটা বাম সংগঠন থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে- স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তার কোনো সংগঠন ডাকসুতে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না বা নির্বাচনে করতে পারবে না।
মাহমুদুর রহমান মান্না : স্বাধীনতাবিরোধী বলতে কী বোঝায়?
আমাদের সময় : একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল...
মাহমুদুর রহমান মান্না : ওই সময় অনেকেই চেতনাগতভাবে মনে করেছে পাকিস্তান ভেঙে ফেললে এটা ভারতের পক্ষে চলে যাবে বা দেশ ছোট হয়ে যাবে। বিরোধিতা করলেও কেউ রাজাকার হয়নি। স্বাধীনতা বিরোধিতার যদি দৃশ্যত প্রমাণ থাকে, তাহলে তাদের রাজনৈতিকভাবেই নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আছে। এতগুলো বছর সেটা করা হলো না। যদিও ফ্যাসিবাদী সরকার (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করল। বর্তমানে আবার তারা বৈধতা ফিরে পেল।
ডাকসুতে শিবির নামে তারা নির্বাচন করছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন আইনে তাদের যাত্রাপথ বন্ধ করবে? শিবিরকে নির্বাচন করতে দেওয়া যাবে না বলে হইচই বা আন্দোলন কেউ করতে পারে, তবে এখন রাজনৈতিক শক্তির সমীকরণে আমার মনে হয়েছে সেটা সফল হবে না।
আমাদের সময় : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট হওয়ার আলোচনা আছে। আপনারা কোন জোটে যাচ্ছেন?
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মাহমুদুর রহমান মান্না : আসলে এমন কোনো প্রস্তাব বিএনপি আমাদের দেয়নি। আমরাও এটা আলোচনা করিনি। বিএনপির সঙ্গে আমরা কোনো জোটে নেই, যুগপৎ আন্দোলনে আছি। সেই আন্দোলন পরিণতি পেয়েছে। তার পরও আমরা সেই জোট ভেঙে দেইনি বা ইতি টানিনি। ওইটার মধ্যে থেকেই সংস্কার কর্মসূচি আসছিল। বিএনপি এখন বলছে যে, এই সংস্কারটাও আমরা এক সঙ্গেই করি। তারেক রহমান বলেছেন, আমরা নির্বাচনের পরে একটা জাতীয় সরকার করব। তবে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া বা মতামত দেইনি। আমাদের জোট একটা আছে- গণতন্ত্র মঞ্চ। এখানেও ছোটখাটো ব্যাপারে আমাদের চিন্তার ভিন্নতা হচ্ছে। আমরা এগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করছি। প্রাথমিকভাবে আমরা আমাদের জোটকে স্পষ্ট করে কিছু কর্মসূচি দেব। এটা ঠিক যে, ৫ আগস্টের পরে দেশে এক ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা, মৌলবাদী চিন্তা, অপসংস্কৃতির চর্চা দেখা যাচ্ছে। ওগুলোর সঙ্গে দর্শনগতভাবেই আমরা থাকব না।
আমাদের সময় : ধর্মীয় উগ্রতা, মৌলবাদী চিন্তার উত্থানের বিষয়ে আপনারা উদ্বিগ্ন কিনা?
মাহমুদুর রহমান মান্না : এটা অতটা অর্গানিক (প্রাকৃতিক) না; অনেকটাই মেকানিক্যাল (কৃত্রিম অর্থে)। অতীতে এরা আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকে গু-ামি করেছে। এখন আবার নিজেদের জায়গায় চলে এসেছে। আবার কেউ কেউ হয়তো রয়েও গেছে। তাদের জায়গা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতি করা যায়। কিন্তু তাদের কথা মানুষকে কতটুকু টেনেছে? আমি মনে করি টানেনি। আওয়ামী লীগ নেই, ফলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিরোধী দলে কে যাবে- এমন প্রশ্ন অনেকের মধ্যে আছে। সময় গেলে তা স্পষ্ট হবে।
আমাদের সময় : দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো যে সংগঠিত হচ্ছে, বিরাট সমাবেশ করছে, তা কি প্রগতিশীল চিন্তা বা প্রগতিশীল রাজনীতিতে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না : এভাবে মনে না করাই ভালো। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা আছে। অনেকেই মনে করে যে, ইসলামি শক্তিগুলো বিপ্লব করতে পারে। এখানে ইসলামপন্থি যত দলের কথা বলা হচ্ছে, সবাই ঐক্যবদ্ধ না। আমরা সুস্পষ্টভাবে যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল, এখনও মনে মনে স্বাধীনতাকে মানতে পারে না, তাদের বিপক্ষে।
আমাদের সময় : আপনাদের দলগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না : আমরা দলগতভাবে কোনো প্রস্তুতি এখনও নিচ্ছি না। আমাদের একটা ধারণা আছে। বাকিটা যেভাবে ইকুয়েশনটা (সমীকরণ) দাঁড়াবে, সেটার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। অথবা স্বতন্ত্রভাবে অন্য ইকুয়েশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।
আমাদের সময় : সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বলুন।
মাহমুদুর রহমান মান্না : জুলাই অভ্যুত্থানে এত অত্যাচার করে পুলিশ যে ট্রমাতে ছিল, তারপর জনগণ যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ভয়টা এখনও কাটেনি। সরকারেরই এই ভয়টা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা দরকার ছিল। পুলিশ তো আমাদের লাগবেই। এটা বললে ভালো হতো, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ কিংবা এই আন্দোলনবিরোধী ছিল, তাদের বিচার হবে। বাকিদের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু সরকার এটাকে শৃঙ্খলায় আনতে পারেনি।