১৩ বছর ধরে গুম /
মুকাদ্দাসকে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছে পরিবার
‘পিতার কাধে সন্তানের লাশ অনেক ভারী’ এ কথা সত্যি ঠিকই। কিন্তু সেই সন্তানের লাশটুকুই যদি না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে গুম হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী পিরোজপুরের আল-মুকাদ্দাস এবং ঝালকাঠীর ওয়ালীউল্লাহ। এরপর দিন গুনে গুনে পার হয়ে গেল ১২টি বছর। গুমের পর তাদের কোথায় রাখা হলো? বেঁচে আছে নাকি মারা গেছেন? মারা গেলে তাদের লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছে? নাকি দাফনের ব্যবস্থাও করেনি গুম খুনের নেপথ্যের কুশীলবরা? এসব প্রশ্নের জবাব আজও কেউ দিতে পারেনি কেউ। তাদের ফিরে পাওয়ার আশায় আজও ছটফট করছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। ২ ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় ছিল মুকাদ্দাস। ছোট বোন বিবাহিত এবং ছোট ভাই চট্টগ্রামে বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র।
অপরদিকে পিরোজপুর সদর উপজেলার খানাকুনিয়ারী গ্রামের মাওলানা আব্দুল হালিম ও মা আয়শা ছিদ্দিকার ১ম সন্তান আল-মুকাদ্দাস ছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫-০৬ সেশনে আল-ফিকহ্ (এল এল বি) বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
গতকাল শুক্রবার নিজ বাড়িতে মুকাদ্দেসের পিতা অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বরিশাল বিভাগীয় ওলামা বিভাগের সভাপতি ও জেলা জাতীয় ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল হালিম (৭২) আলাপকালে জানান, সাড়ে ১৩ বছর আগে ২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে (৩৭৫০) কুষ্টিয়া যাচ্ছিলেন দুই বন্ধু পিরোজপুরের আল-মুকাদ্দাস এবং ঝালকাঠীর ওয়ালীউল্লাহ। কল্যাণপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টায় বাসটি যাত্রা শুরু করে। রাত ১টার দিকে সাভারের নবীনগর পৌঁছালে র্যাব-৪ এর কালো গাড়ি থেকে র্যাবের পোশাক পরা ৮-১০ জন এবং সঙ্গে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন হানিফ পরিবহনের গাড়িটি থামিয়ে হনহন করে গাড়িতে উঠে র্যাব ও ডিবি পরিচয়ে সবার মাঝ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওয়ালীউল্লাহ ও মুকাদ্দাসকে। এরপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
তিনি জানানা, ওয়ালীউল্লাহ ছাত্রশিবিরের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন অর্থ সম্পাদক এবং মুকাদ্দাস সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পর ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দারুসসালাম থানায় জিডি করেন (জিডি নং-৩১৭) তাদের পরিবার। এরপর পুলিশ ও র্যাবসহ প্রশাসনের কাছে বারবার ধরণা দিয়েছেন পরিবার। হাইকোর্টে রিটও হয়। তাদেরকে উদ্ধারের দাবিতে ক্যাম্পাসে ধর্মঘট, মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন আন্দোলন করেন ইবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আকুল আবেদন জানান পরিবার।
এর পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকেও সরকারকে আহ্বান জানানো হয় বলে জানান মুকাদ্দেসের পিতা মাওলানা আব্দুল হালিম। কিন্তু এতকিছুর পরেও কেউই তাদের সন্ধান দিতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গুমের খবর অস্বীকার করে। এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। ওই তালিকায় নাম আছে মুকাদ্দাস ও ওয়ালীউল্লাহর।
মুকাদ্দেসের পিতা মাওলানা আব্দুল হালিম (৭২) বলেন, ‘গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে গুম হওয়া অনেককেই উদ্ধার করা হয়েছে গোপন বন্দিশালা থেকে। এছাড়া গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও এসব ঘটনার তদন্তে ২৭শে আগস্ট কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপরই নতুন করে আশার আলো দেখতে শুরু করেছিল সকলের পরিবার। মুকাদ্দাসকে ফিরে পাওয়ার আশায় পথপানে তাকিয়ে আছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘মুকাদ্দাস কোথায় আছে, কেমন আছে, সেটা অন্তত আমরা জানতে চাই। সম্প্রতি গুমের ঘটনা তদন্তে সরকার কমিশন গঠন করেছে।’
এ সময় মুকাদ্দাসের মা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘আজও ছেলের ফেরার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এখনো স্বপ্ন দেখি ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে, মা বলে ডাকছে।’
বাবা আব্দুল হালিমের ভাষ্য, ‘ছেলে এখনো বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। আজও জানতে পারিনি। যদি জীবিত থাকে, তবে তাকে সামনে আনা হোক। আর যদি মেরে ফেলা হয়, তবে অন্তত তার কবরটা আমাদের দেখাক।’
ছেলের ফেরার আশা ছাড়েননি তারা কেউই। মা-বাবার বিশ্বাস, একদিন তাদের ছেলে ঠিকই ফিরে আসবে। মা-বাবার শেষ ইচ্ছা, জীবিত থাকাকালিন যে বা যারা এই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের সঠিক বিচারটা যেন দেখে যেতে পারেন।