ফারমারস মিনি কোল্ড স্টোরেজে আশার আলো দেখছেন কৃষকরা

নিজস্ব প্রতিনিধি
২৭ আগস্ট ২০২৫, ২১:০৪
শেয়ার :
ফারমারস মিনি কোল্ড স্টোরেজে আশার আলো দেখছেন কৃষকরা

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মেদুলিয়ায় উদ্বোধন হলো দেশের প্রথম ফারমারস মিনি কোল্ড স্টোরেজ। প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে সেখানে ভিড় জমিয়েছিলেন কয়েক শ কৃষক। কেউ টমেটো, কেউ ফুলকপি, কেউ আবার লাউ, কুমড়া বা পেঁপে চাষ করেন, কিন্তু ফলন বেশি হলে তাদের মুখে আনন্দের বদলে নেমে আসে হতাশা। কারণ মৌসুমে বাজারে সবজি উপচে পড়লে দাম পড়ে যায়, লোকসান গুনতে হয় কৃষককে। সেই নিয়তি ভাঙার আশাতেই কৃষকের মুখে ফুটেছে নতুন আশার আলো।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্প ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি’ এর আওতায় সারাদেশে ১০০টি মিনি কোল্ড স্টোরেজ বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে মেদুলিয়া সমন্বিত কৃষক উন্নয়ন সংঘের হাতে হস্তান্তর করা হয় প্রথম ইউনিটটি।

আজ বুধবার উদ্বোধন করেন কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব,) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি ফিতা কেটে ও প্রতীকী চাবি হস্তান্তরের মাধ্যমে কার্যক্রমের সূচনা করেন এবং পরে কোল্ড স্টোরেজের ভেতর ঘুরে সংরক্ষণব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। প্রায় তিন শতাধিক কৃষকের সঙ্গে মতবিনিময়কালে কৃষকেরা জানান, এ প্রযুক্তি তাদের জন্য আশীর্বাদ হলেও প্রয়োজন আরও বেশি ইউনিট। পাশাপাশি স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, খাল মুক্ত করা, ব্রিজ নির্মাণ এবং সবজি সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপনের দাবিও জানান তারা। উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষি উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের কৃষক জাতির প্রাণ। তাদের ঘামেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ফসল সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আজকের উদ্যোগ সেই ক্ষতি কমিয়ে আনবে। আমরা চাই সহজ ঋণ ও ভর্তুকির মাধ্যমে এ প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।

কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ছোট কোল্ড স্টোরেজ উৎপাদনের স্থায়িত্ব বাড়াবে, ক্ষতি কমাবে এবং বাজারে সঠিক দামে বিক্রির সুযোগ তৈরি করবে।

প্রকল্প পরিচালক ও মডেলের উদ্ভাবক তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, এটি শুধু একটি যন্ত্র নয়, কৃষকের বাঁচার হাতিয়ার। খরচ কম, ব্যবহার সহজ এবং প্রয়োজনে সৌরশক্তিতেও চালানো যাবে। আমার স্বপ্ন দেশের প্রতিটি গ্রামে এমন কোল্ড স্টোরেজ পৌঁছে দেওয়া।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কোল্ড স্টোরেজ দুটি মডেলে তৈরি করা যায়। এক, ঘরভিত্তিক (টিএসসিআর) ও অপরটি কনটেইনারভিত্তিক (টিএসসিসি) মডেলে। দুটিই সৌরচালিত, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। বিশেষ সেন্সরের মাধ্যমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা মোবাইল অ্যাপ থেকেও পরিচালনাযোগ্য। মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় নির্মিত ঘরভিত্তিক ইউনিট ধারণ করতে পারে ১০ টন পণ্য, আর কনটেইনারভিত্তিক সংস্করণের খরচ ১৫ লাখ টাকা। প্রচলিত কোল্ড স্টোরেজের তুলনায় ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ কম।

স্থানীয় কৃষক আব্দুল করিম বলেন, আগে শীতকালে টমেটো-ফুলকপি মাটিতে পুঁতে রাখতে হতো। এখন কোল্ড স্টোরেজে রেখে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে।

নারী কৃষক শামিমা বেগম জানান, ‘ফসল নষ্ট হতো, এখন তা সংরক্ষণ করা যাবে। নিজেদের দাম নিজেরাই ঠিক করতে পারব। এটি আমাদের জন্য আশীর্বাদ।’

এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক দশকে সবজি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় এক কোটি টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ টন, আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টনে। কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে মৌসুমে দাম পড়ে যায়, সংরক্ষণাগার না থাকায় কৃষক লোকসান গুনেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছোট কোল্ড স্টোরেজ বাজার মূল্য স্থিতিশীল করবে, অপচয় কমাবে, গুণগত মান বজায় রাখবে এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

অনুষ্ঠানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং কৃষি কর্মকর্তাসহ তিন শতাধিক কৃষক উপস্থিত ছিলেন।