এলডিসি উত্তরণ পাঁচ বছর পেছানোর দাবি ব্যবসায়ী নেতাদের
১৬ বাণিজ্য সংগঠনের একাত্মতা প্রকাশ
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সময়সীমা ৩ থেকে ৫ বছর পিছিয়ে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা হারানো, ওষুধ ও তৈরি পোশাক শিল্পের সংকট মোকাবিলা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার প্রস্তুতির জন্য এই অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন বলে জানান তারা।
গতকাল রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ আয়োজিত ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন : চ্যালেঞ্জেস অ্যাহেড’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়। এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ-সহ দেশের ১৬টি বাণিজ্য সংগঠন। অনুষ্ঠানে এসব সংগঠন ও চেম্বারের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা যৌথভাবে এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আহ্বান জানানা।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, বিতর্কটি ‘উত্তরণ করা হবে কি না’ তা নিয়ে নয়, বরং ‘কীভাবে করা হবে’ তা নিয়ে। উত্তরণ নিশ্চিত; কিন্তু সাফল্য নিশ্চিত নয়। ব্যবসায়ীরা বলেন, এটি নির্ভর করবে আমরা কত দ্রুত ও সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে পারি তার ওপর।
লিখিত বক্তব্যে আইসিসি বাংলাদেশ সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এলডিসি উত্তরণকে স্বাগত জানায়। তবে আমরা জোর দিয়ে বলছি, ৩ থেকে ৫ বছরের একটি বাড়তি সময় পাওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এই অর্জন জাতির জন্য গর্বের হলেও সঠিকভাবে মোকাবিলা না করলে তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বয়ে আনতে পারে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণ দেশের জন্য একটি বড় অর্জন হলেও এর সঙ্গে বেশ কিছু ঝুঁকি ও দায়িত্ব জড়িয়ে আছে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রধান বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হতে পারে। এর ফলে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অধীনে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা, যেমন রপ্তানিতে ভর্তুকি এবং মেধাস্বত্ব আইনের ছাড়, বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া সহজ শর্তের বদলে বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক হারে ঋণ নিতে হবে, যা ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়াবে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ওষুধ ও তৈরি পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করে। মেধাস্বত্ব চুক্তিতে ছাড় পাওয়ার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উত্তরণের পর এই সুরক্ষা উঠে গেলে ক্যানসার ও এইচআইভির মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
আরও জানানো হয়, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশের বেশি জোগান দেওয়া তৈরি পোশাক খাতকেও (আরএমজি) কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং কঠোর কমপ্লায়েন্স আইন এই খাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটগুলো তুলে ধরে আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি বলেন, এই পরিস্থিতিতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আরও কঠিন হবে। খেলাপি ঋণ এবং দুর্বল শাসনের কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭.৫৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০২৪ সালে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৩ শতাংশ কমে ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ভিয়েতনামের এফডিআই ছিল ৩৮.২৩ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি সংকট, লজিস্টিকস দুর্বলতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ৪৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন, যা আমদানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে। জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থনীতিকে আরও নাজুক করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিভিন্ন দেশ প্রস্তুতির জন্য এলডিসি উত্তরণ বিলম্বিত করেছে। মালদ্বীপ ৮ বছর, নেপাল ৫ বছর সময় নিয়েছে। মিয়ানমার ও তিমুর-লেস্তে যোগ্যতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তাদের উত্তরণ স্থগিত রাখা হয়েছে।